চীনের 'বরফের শহর' হারবিন
  2016-02-05 19:04:18  cri

সেন্ট সোফিয়া ক্যাথিড্রাল

এখন চীনে শীতকাল চলছে। দেশটির সবচেয়ে উত্তরে অবস্থিত হারবিন নামের একটি শহর। হারবিন হচ্ছে হেইলুংচিয়াং প্রদেশের রাজধানী এবং উত্তর-পূর্ব চীনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। শহরের আয়তন প্রায় ৫৩ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি ৬৪ লাখ। হারবিন শহরের শীতকাল দীর্ঘ। জানুয়ারিতে শহরের গড় তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাই চীনের এই শহরটি 'বরফের নগর" নামে সুপরিচিত। এ ছাড়া শহরের অন্য একটি নামও আছে। নামটি হচ্ছে: "প্রাচ্যের প্যারিস"।

হারবিনের ভৌগোলিক অবস্থান ও পরিবহন-ব্যবস্থা ভালো। শহরটি উত্তর-পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ ও প্যাসিফিকের সংযোগস্থল। হারবিন থাই পিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হচ্ছে চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দ্বিতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। চীনের বিভিন্ন শহরগামী ফ্লাইট ছাড়া, জাপানের নিগাতা-কেন, দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল, রাশিয়ার খাবারোভস্ক এবং চীনের হংকংয়ের সঙ্গে শহরটির আকাশপথে যোগাযোগ আছে।

এ ছাড়া শেন ইয়াংয়ের পর হারবিন হচ্ছে চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেলপথ সংযোগস্থল। শহর থেকে দ্রুতগতির ট্রেনে করে শুধুমাত্র ৫ ঘন্টায় বেইজিং পৌঁছানো যায়।

হারবিন উচু অক্ষাংশ অঞ্চলে অবস্থিত। শীতকালে হারবিনের তাপমাত্রা মাইনাস বিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। ফলে হারবিন তার নিজস্ব "বরফ সংস্কৃতি" গড়ে তুলেছে এবং চীনের হারবিন আন্তর্জাতিক বরফ উত্সবস্থলে পরিণত হয়েছে। ১৯৮৫ সাল থেকে প্রতিবছরের ৫ জানুয়ারি হারবিনে বরফ উত্সবের উদ্বোধন হয়। সারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দেশি-বিদেশি অতিথিরা আসেন।

বরফ উত্সব একটানা ১০০ দিন চলতে থাকে। বরফ উত্সব চলাকালে হারবিন শহরের রাস্তায় রাস্তায় বরফ ভাস্কর্য দেখা যায়। সেখানকার বরফ ভাস্কর্য কেবল স্বচ্ছ তাই নয়, কোন কোন ভাস্কর্যের মধ্যে খাবারযোগ্য রং বা রঙিন প্র্রদীপ দেয়া হয়। সুতরাং রাতে বরফ ভাস্কর্য দেখতে খুব সুন্দর ও মনোরম।

কিন্তু বরফ ভাস্কর্য কিভাবে তৈরি হয়? আসলে হারবিনের পাশে অবস্থিত সোংহুয়াচিয়াং নদী এক বিরাট বরফ মাঠে পরিণত হয়। যেখানে বরফ সবচেয়ে গভীর, সেখানে গাড়ি চালানো যায়। হারবিনের অধিবাসীরা বিশেষ যন্ত্র দিয়ে বরফের বিভিন্ন রকম মূর্তি কাটেন। এই বরফ হচ্ছে বরফ ভাস্কর্য তৈরীর সবচেয়ে প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক উপাদান।

রাস্তায় ও পার্কে বরফ ভাস্কর্য উপভোগ করার পাশাপাশি, আপনি সোংহুয়াচিয়াং নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত বরফ বিশ্ব পার্কে যেতে পারেন। বরফ বিশ্ব পার্কের আয়তন ৪ লাখ বর্গমিটার। এটা হচ্ছে হারবিন শহরের বৃহত্তম বরফ সম্পর্কিত পার্ক। সেখানে প্রাচীনকালের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ভবন , রাজপ্রাসাদ, দুর্গ ইত্যাদি সবই বরফ দিয়ে তৈরি। প্রতি বছর বরফ বিশ্ব পার্কে এক বিশেষ প্রতিপাদ্য থাকে। আপনি বরফ দিয়ে তৈরি ধাপে হেঁটে হেঁটে ওপরে যেতে পারেন। ক্লান্ত হলে পার্কের ভিতরে বরফ দিয়ে তৈরি বারে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে শত বছরের পুরাতন হারবিন বিয়্যার খেতে পারেন। সাধারণত এখানকার টিকিটের দাম ৩শ' ইউয়ান। ছুটি বা উত্সব চলাকালে টিকিটের দাম ৩৩০ ইউয়ান।

হারবিনে গেলে বরফ ভাস্কর্য ছাড়া তুষার ভাস্কর্যও দেখতে হবে। সোংহুয়াংচিয়াং নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত সূর্যদ্বীপ হচ্ছে তুষার ভাস্কর্য উপভোগ করার ভাল জায়গা। সূর্যদ্বীপে বায়ু খুব টাটকা, দুষণমুক্ত এবং তুষারের গূণগত মান ভালো। প্রতি বছর এখানে তুষার ভাস্কর্যমেলা অনুষ্ঠিত হয়।

আপনি হয়তো জিজ্ঞেস করতে চান, তুষার খুব নরম, কিভাবে বিরাট আকারের ভাস্কর্য খোদাই করা যায়? তুষার ভাস্কর্য আর বরফ ভাস্কর্যের পার্থক্য কি? "বরফ ভাস্কর্য দেখতে স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। এতে শিল্পীর মনের প্রতিফলন ঘটে। মাইনাস পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কৃত্রিম তুষার উত্পাদিত হয়। প্রথমে এই কৃত্রিম তুষারকে কাগজ দিয়ে তৈরি এক বড় বক্সের মধ্যে ভরা হয়। তারপর কাগজের বাক্সকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এভাবে খোদাই করা তুষার তৈরি হয়।"

হারবিন অধিবাসীদের হাতে বরফ ও তুষার শিল্পকলায় পরিণত হয় তা নয়, তুষার দিয়ে এখানে বিনোদনের ব্যবস্থাও করা হয়। হারবিনের চাও লিন পার্কে ৬০ মিটার দীর্ঘ একটি বিরাট বরফ গোলকধাঁধাঁ আছে। গোলকধাঁধাঁর প্রস্থানের পথ খোঁজার সময় অবশ্যই একটু সাবধানে থাকবেন। না হলে সহজে হোঁচট খাবেন। অনেকে ছোট বেলায় গড়ানো খেলার যন্ত্র খেলতো। এখানে আসলে আপনারা দশ মিটার উচু বরফ গড়ানো খেলার যন্ত্র খেলতে ভুলবেন না। এর উপরে বসে দ্রুতই নেমে আসার সময় কানে বাতাসের শব্দ ভেসে আসে। হৃতপিণ্ডও দ্রুত উঠানামা করে। তা ছাড়া আপনি বরফ সাইকেলও চালাতে পারেন। বরফ সাইকেল সাধারণ সাইকেলের চেয়ে অনেক ছোট। স্কেইট সামনের চাকার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। পিছনের চাকার দু'পাশেও স্কেইট বোর্ড বসানো আছে।

আপনি আরও বেশি বরফ ক্রীড়ার মজা অনুভব করতে চাইলে সোংহুয়াচিয়াং নদীতে যান। শীতকালের সোংহুয়াচিয়াং নদী হচ্ছে হারবিন শহরের একটি প্রাকৃতিক খেলার মাঠ। এখানে পর্যটকরা কুকুর-টানা স্লেজ-গাড়িতে বসে সোংহুয়াচিয়াং নদীর দু'পারের সুন্দর দৃশ্য দেখতে পারেন। অথবা শীতকালীন সাঁতার অনুরাগীদের সাঁতার দেখতে পারেন। হারবিনের শীতকালীন সাঁতারের সুদীর্ঘকালের ইতিহাস আছে। এটা "সাহসীদের ক্রীড়া" বলা যায়। চীনের শীতকালীন সাঁতার অনুরাগীদের মধ্যে ২০ বছর বয়স্ক যুবকযুবতী যেমন আছেন, ৮০ বছর বয়স্ক বৃদ্ধবৃদ্ধাও আছেন।

বরফ ক্রীড়া সম্পর্কে বলতে গেলে আরেকটি কথা উল্লেখ করা যায়, তা হচ্ছে স্কী। হারবিন স্কী করার এক ভালো জায়গাও বটে। হারবিনে অনেক স্কী মাঠ আছে। এর মধ্যে ইয়াবুলি স্কী মাঠ সবচেয়ে বিখ্যাত এবং চীনের সবচেয়ে ভাল স্কী মাঠ। সেখানকার সর্বোচ্চ পর্বত সমুদ্রতল থেকে প্রায় ১৩৭৪ মিটার উচু। চরম নিম্ন তাপমাত্রা মাইনাস ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রতি বছরের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে পরের বছরের মার্চ মাসের শেষ দিক পর্যন্ত স্কী করার শ্রেষ্ঠ সময়।

জোং ইয়াং তা চিয়ে অর্থাত্ কেন্দ্রীয় সড়ক ১৮৯৬ সালে নির্মিত। এটা হচ্ছে বর্তমানে এশিয়ার বৃহত্তম ও সবয়ে দীর্ঘ্য হাঁটার রাস্তাগুলোর অন্যতম। এখানে রেনেসাঁ ও বারোকসহ বিভিন্ন স্টাইলের ১৩টি স্থাপত্য রয়েছে।

গোগোল স্ট্রিট হারবিন শহরের একটি গভীর রুশ স্টাইলের স্ট্রিট। স্ট্রিটের শতাধিক বছরের ইতিহাস আছে। বিখ্যাত সাংস্কৃতিক স্ট্রিট ছাড়া এটা হচ্ছে একটি বার স্ট্রিট। এখানকার রাতের দৃশ্য খুবই সুন্দর।

সেন্ট সোফিয়া ক্যাথিড্রাল হচ্ছে দূর-প্রাচ্য অঞ্চলে বৃহত্তম ওর্থাডক্স সম্প্রদায় গির্জা। এখন এটা প্রদেশের আর্ট স্থাপত্য জাদুঘরে পরিণত হয়েছে। এখানকার টিকিটের দাম ২০ ইউয়ান। উল্লেখ্য, সারা বিশ্বে শুধুমাত্র দু'টো এরকমের গির্জা আছে। অন্য একটি রাশিয়ার সেন্ট পিটারসবার্গে অবস্থিত।

বন্ধুরা, যেহেতু শীতকালে হারবিনের তাপমাত্রা খুব কম, সেহেতু সেখানে যাওয়ার আগে শীত প্রতিরোধে প্রচুর কাপড়চোপড়, টুপি ও দস্তানা নিয়ে নেবেন। জুতাও কিনতে হবে বিশেষ ধরনের যাতে পা পিছলে না-যায়। (প্রেমা/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040