১৮৭২ সালে মার্কিন কংগ্রেস ইয়েলোস্টন জাতীয় পার্ক নির্মাণের অনুমোদন দিয়ে আইন প্রণয়ন করে। এটি শুধু যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম জাতীয় পার্ক তা নয়, বরং বিশ্বের প্রথম জাতীয় পার্ক। কিন্তু মার্কিন জাতীয় পার্কব্যবস্থা ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন প্রেসিডেন্ট থমাস উড্রো উইলসন 'জাতীয় পার্ক সংস্থা প্রতিষ্ঠা আইন' স্বাক্ষর করেন। মার্কিন জাতীয় পার্ক পরিচালনা ব্যুরো প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যুরোটি দৃশ্য এলাকা, প্রাকৃতিক পরিবেশ, বন্যপ্রাণী ও ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার সুরক্ষা করার দায়িত্ব পালন করে। ২০১৬ সাল ছিল মার্কিন জাতীয় পার্কব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ১০০তম বার্ষিকী।
আপনারা শুনছেন মার্কিন জাতীয় পার্কব্যবস্থা প্রতিষ্টার শততম বার্ষিকীর গান। গানে আমরা মানুষের কন্ঠ, জাহাজের হর্ণ, ও বিভিন্ন পশুর ডাক শুনতে পাই। গানে জাতীয় পার্কের মৌলিক ধারণা প্রতিফলিত হয়েছে। আর এ ধারণা হচ্ছে: মানুষ ও প্রকৃতির সম্প্রীতি।
কিন্তু আসল সম্প্রীতি কী? কঠিন পরিশ্রম ও চ্যালেঞ্জে মোকাবিলা করে মার্কিন জাতীয় পার্কের পরিচালকরা তা বুঝতে পেরেছেন।
বিশ্বের প্রথম জাতীয় পার্ক—ইয়েলোস্টন পার্কে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক আসেন। পর্যটকরা পার্কটির ঝর্ণা ও জলপ্রপাতসহ প্রাকৃতিক দৃশ্য ছাড়াও, আমেরিকান বাইসন ও নেকড়েসহ বিভিন্ন ধরণের পশু দেখতে পারেন। ইয়েলোস্টন পার্কের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিশ্বের প্রথম জাতীয় পার্ক হিসেবে ইয়েলোস্টন নির্মাণের শুরু থেকে প্রাকৃতিক পরিবেশ অক্ষুন্ন রাখার নীতি বজায় আছে।
যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীন হওয়ার পর এক শতাব্দী ধরে পশ্চিমাঞ্চলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলেছে। পূর্বাঞ্চলের মানুষ পশ্চিমাঞ্চলে অভিবাসন করেছেন। ইয়েলোস্টনের কাছাকাছি অবস্থিত বন খামারবাড়িতে পরিণত হয়। এতে নেকড়েসহ বিভিন্ন বন্যপশুর বসবাসের পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যায়। পার্কটির ইতিহাসে সর্বশেষ নেকড়ে দেখা গেছে ১৯২৬ সালে। কিন্তু কয়েক দশক পর বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন যে, নেকড়ে না-থাকায় এলাকায় তৃণভোজীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এর ফলে স্থানীয় গাছপালা ও বনে গুরুতর ক্ষতি হয়। ফলে সমাজ প্রকৃতি সুরক্ষার ধারণা ক্রমান্বয়ে গ্রহণ করে। মার্কিন কংগ্রেসে এ সম্পর্কিত ধারাবাহিক আইন গৃহীত হয়।
১৯৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মত্স্য ও বন্যপশু পরিচালনা ব্যুরো ইয়েলোস্টন পার্কে পুনরায় নেকড়ে নিয়ে আসার প্রস্তাব করে। কয়েক বছরের পর্যবেক্ষণ ও তদন্তের পর মার্কিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পার্কটিতে নেকড়ে ছাড়ার পরিকল্পনা অনুমোদন করে। ইয়েলোস্টন পার্কের একজন ইতিহাববিদ এ সম্পর্কে বলেন,'১৯৯৫ সালে নেকড়ে পুনরায় ইয়েলোস্টন পার্কে প্রবেশ করে। আসলে এ পার্ক নেকড়ে'র জন্য খুবই উপযুক্ত। ৬০ বছরেরও বেশি সময় পর আমরা নেকড়ের ডাক শুনতে পাই।'
এখন ইয়েলোস্টন পার্কে নেকড়ের সংখ্যা প্রায় ১০০টি। এখন পার্কটিতে প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় পার্ক পরিচালনা ব্যুরো আছে। রাজ্যগুলোর সরকার পার্ক পরিচালনার অধিকার ভোগ করে না। পাশাপাশি ফেডারেল সরকার জাতীয় পার্কের ৭০ শতাংশ ব্যয় বহন করে। বাকি অর্থ আসে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দান ও জাতীয় পার্ক তহবিলের অর্থ থেকে।
মার্কিন জাতীয় পার্কব্যবস্থায় শুধু যে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায় তা নয়, এ ব্যবস্থায় সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক দৃশ্যও অন্তর্ভুক্ত। মার্কিন জাতীয় পার্ক পরিচালনা ব্যুরোর আন্তর্জাতিকবিষয়ক কর্মকর্তা বলেন, জাতীয় পার্ক যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে। এ সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, 'জাতীয় পার্ক পরিচালনা ব্যুরোর অধীনে শুধু ৫৯টি প্রাকৃতিক দৃশ্য পার্ক আছে তা নয়, বরং ব্যুরো মোট ৪১৩টি পার্ক পরিচালনা করে, যেগুলোর মধ্যে সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শনযুক্ত পার্কও আছে। যেমন, নিউইয়র্কে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, ফিলাডেলফিয়ায় 'স্বাধীন ঘোষণা' খসড়া প্রণয়নের স্বাধীন হল, ওয়াশিংটনে ওয়াশিংটন মনুমেন্ট, জেফারসন মেমোরিয়াল, আব্রাহাম লিঙ্কনের মেমোরিয়াল ও জাতীয় বনভূমি ইত্যাদি।'
তিন কিলোমিটার দীর্ঘ জাতীয় বনভূমি মার্কিন কংগ্রেস ভবন ও আব্রাহাম লিঙ্কন মেমোরিয়াল'র মাঝখানে অবস্থিত। জাতীয় বনভূমির মাঝখানে ওয়াশিংটন মনুমেন্ট অবস্থিত। এটি হল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস ও রাজনীতির একটি অংশ এবং দেশপ্রেম শিক্ষাকেন্দ্র। প্রতি বছর প্রায় ২.৪ কোটি পর্যটক এখানে বেড়াতে আসেন।
২০১৬ সালে মার্কিন জাতীয় পার্কগুলো প্রচুর পর্যটক আকর্ষণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত্ ইতিহাসবেত্তা ও পরিবেশবিদ ওয়ালেস স্টেগ্নার বলেন, জাতীয় পার্ক যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে ভাল ধারণা। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে জাতীয় পার্কের ধারণা সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়। এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে জাতীয় পার্ক হিসেবে সংরক্ষিত এলাকা আছে চার হাজারের মতো। মার্কিন জাতীয় পার্ক পরিচালনা ব্যুরোর আন্তর্জাতিক বিষয়ক কর্মকর্তা মনে করেন, চীনও এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারে। তিনি বলেন,
'চীনের উচিত একটি জাতীয় পার্কব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।'