উইম্যান পেস-সেটার অধ্যাপক সুন ছি সিয়াং
  2017-03-08 14:23:19  cri



আজ ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বের সকল নারীকে আমরা শুভেচ্ছা জানাই।

চীনে শ্রেষ্ঠ নারীদের নিয়মিত একটি সরকারি পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কারের নাম: উইম্যান পেস-সেটার (woman pace-setter)। সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য সাধারণত এ পুরস্কার দেওয়া হয়। আজকের পুবের জানালা অনুষ্ঠানে আমরা একজন 'উইম্যান পেস-সেটার' বিজয়ীর কথা বলবো। তিনি হলেন বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুন ছি সিয়াং।

বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি একাডেমির ইতিহাস শতাধিক বছরের। ৬০ বছর বয়সী অধ্যাপক সুন ছি সিয়াং এ একাডেমির প্রধান। তিনি চলতি বছরের 'উইম্যান পেস-সেটার' পুরস্কার পেয়েছেন। যখন তিনি পুরস্কার পাওয়ার কথা জানলেন, তখন তিনি শিক্ষার্থীদের গবেষণামূলক প্রবন্ধ দেখছিলেন। তিনি ব্যস্ত মানুষ। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সম্মেলন, স্কুলের সভা, ক্লাস নেওয়া, একাডেমির প্রধানের দায়িত্ব ইত্যাদি নিয়ে তার ব্যস্ত জীবন। একাডেমির প্রধান হলেও তিনি নিয়মিত ক্লাশ নেন।

পুরস্কার পাওয়ার পর তার অনুভূতি প্রকাশ করে সুন ছি সিয়াং বলেন, 'আমি এ পুরস্কার পাওয়ায় নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। এ পুরস্কার আমাকে উত্সাহ দেবে এবং ভবিষ্যতে একজন শিক্ষক হিসেবে আরও ভালোভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করতে অনুপ্রাণিত করবে।'

সু ছি সিয়াং জানালেন, বিশ্ববিদ্যায়ে ভর্তি হওয়া এবং কমিউনিষ্ট পার্টি সদস্য হওয়া তার জীবনের প্রধান দুটি লক্ষ্য ছিল। তার বাবা-মা তাকে একজন সত্যবাদী মানুষ হতে উৎসাহিত করতেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি যা করতেন, খুব ভালোভাবে করার চেষ্টা করতেন। পরবর্তী জীবনে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, বিদেশে লেখাপড়া করতে যান, এবং অবশেষে একাডেমির প্রধান নিযুক্ত হন।

তার সহকর্মী ও ছাত্রছাত্রীদের চোখে সুন ছি সিয়াং খুব পরিশ্রমী একজন মানুষ। বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সময় তিনি প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে গবেষণালয় বা লাইব্রেরিতে যেতেন। সেখানে বসে দিন-রাত পড়াশুনা বা লেখালেখি করতেন। ওই সময় নিজ হাতে লেখা প্রায় আড়াই লাখ অক্ষরের একটি প্রবন্ধ 'বেইজিং দর্শন ও সামাজিক প্রবন্ধ' দ্বিতীয় সেরা পুরস্কার পায়।

তার রচিত একটি বীমাবিষয়ক শিক্ষা-উপকরণ শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক মনোনীত শিক্ষা-উপকরণের স্বীকৃতি পেয়েছে এবং সেটি এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ লাখ কপি ছাপা হয়েছে।

বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি একাডেমির একাডেমিক নেতা হিসেবে তার নেতৃত্বে চলেছে দশ-বারোটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ। এ প্রকল্পগুলো চীনের উন্মুক্তকরণ ও সংস্কার কার্যক্রম এবং বীমাশিল্পের সংস্কারকাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর সুন ছি সিয়াং রাজনীতি বা ব্যবসায় প্রবেশ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সেদিকে যেতে প্রলুব্ধ হননি। ১৯৯৩ সালে বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি একাডেমিতে খোলা হয় বীমা বিভাগ এবং সুন ছি সিয়াং এ বিভাগ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পান। তখন তিনি বীমা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। তাই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বীমা বিষয়ে লেখাপড়া করতে যান এবং বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের বীমা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানি বার্ষিক ৩ লাখ ডলার/ইউয়ানের একটি চাকরি অফার করে তাকে। তিনি সে অফার প্রত্যাখ্যন করেন। অথচ তখন বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে তার মাসিক বেতন ছিল মাত্র ৪০০ ইউয়ান। তিনি বলেন, 'টাকার প্রতি দুর্বলতা আমারও আছে। তবে আমার নীতি ও বিবেক আমাকে ওই অফার ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করে।'

২০১০ সালে সুন ছি সিয়াং বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি একাডেমির প্রধান নিযুক্ত হন। তিনি একাডেমির প্রথম নারী প্রধান। বিগত কয়েক বছরে তার নেতৃত্বে শিক্ষা, গবেষণা ও আন্তর্জাতিক বিনিময়সহ নানা ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করে একাডেমি।

২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক বীমা সোসাইটি বীমা খাতে সর্বোচ্চ পুরস্কার জন এস বিক্‌লে ফাউন্ডারস্‌ অ্যাওয়ার্ডে (John S. Bickley Founder's Award) ভূষিত করে সুন ছি সিয়াংকে। তিনিই চীনের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র ব্যক্তি যিনি এ পুরস্কার পান। তিনি বলেন, 'মাতৃভূমির সমর্থন পেয়েই আমি আজ আন্তর্জাতিক মঞ্চে দাঁড়াতে পেরেছি।'

১৯৮৬ সাল থেকে তিনি যথাক্রমে লান চৌ বিশ্ববিদ্যালয় ও বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন এবং তিনি শতাধিক ডক্টোরেট ও পোস্ট ডক্টোরেট ডিগ্রিধারীর সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি নানা ক্ষেত্রে নানান পুরস্কার পেয়েছেন। তবে তার ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া 'শ্রেষ্ঠ শিক্ষক পুরস্কার' তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ।

সুন ছি সিয়াংয়ের ছাত্রী তুয়ান নান নান মনে করেন, তার শিক্ষক নিখুঁত একজন নারীর প্রতিকৃতি। তিনি সাহসী ও দায়িত্বশীল। বড় সমস্যায়ও ভেঙে পড়েন না, হাল ছেড়ে দেন না। তিনি শ্নেহশীল এবং উত্সাহদাতা। তিনি নারীদের জন্য একটি ভাল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, রোলমডেল হয়েছেন। তিনি স্বাধীন ও আত্মনির্ভরশীল; সমাজে অবদান রেখে চলেছেন। তুয়ান তার মতো একজন নারী হবার স্বপ্ন দেখেন।

সুন ছি সিয়াং বলেন, 'আমি ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে মিশতে পছন্দ করি। তাদের বড় হতে দেখে আমি আনন্দিত হই। শিক্ষকতা পেশা আমাকে পূর্ণ করেছে। অন্য কোনো পেশায় আমি এই পূর্ণতাবোধ অর্জন করতে পারতাম বলে মনে হয় না।'

বর্তমানে সুন ছি সিয়াং নিয়মিত ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করছেন। ২০১৮ সালে তিনি একাডেমির প্রধানের পদ থেকে অবসর নেবেন। তিনি আশা করেন, একাডেমিতে একটি ভালো শিক্ষকদল ও ভালো ব্যবস্থাপনা রেখে বিদায় নিতে পারবেন। (শিশির/আলিম)

[আন্তর্জাতিক নারী দিবস

আন্তর্জাতিক নারী দিবস (আদি নাম আন্তর্জাতিক কর্মজীবী নারী দিবস) প্রতি বছর ৮ মার্চ তারিখে পালিত হয়। সারা বিশ্বব্যাপী নারীরা একটি প্রধান উপলক্ষ হিসেবে এই দিবস উদযাপন করে থাকেন। বিশ্বের এক এক প্রান্তে নারীদিবস উদযাপনের প্রধান লক্ষ্য এক এক প্রকার হয়। কোথাও নারীর প্রতি সাধারণ সম্মান ও শ্রদ্ধা উদযাপনের মুখ্য বিষয় হয়, আবার কোথাও মহিলাদের আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠাটি বেশি গুরুত্ব পায়।

এই দিবসটি উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেই মিছিলে চলে সরকার লেঠেল বাহিনীর দমন-পীড়ন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হলো। ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ; জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। এরপর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বৎসর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয়ঃ ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালিত হতে লাগল। বাংলাদেশেও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতার লাভের পূর্ব থেকেই এই দিবসটি পালিত হতে শুরু করে। অতঃপর ১৯৭৫ সালে খ্রিস্টাব্দে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। এরপর থেকে সারা পৃথিবী জুড়েই পালিত হচ্ছে দিনটি নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার অভীপ্সা নিয়ে।

বিশ্বের অনেক দেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারী ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। তন্মধ্যে - আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বেলারুশ, বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, কিউবা, জর্জিয়া, গিনি-বিসাউ, ইরিত্রিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজিস্তান, লাওস, মলদোভা, মঙ্গোলিয়া, মন্টেনিগ্রো, রাশিয়া, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উগান্ডা, ইউক্রেন, উজবেকিস্তান, ভিয়েতনাম এবং জাম্বিয়া।

এছাড়া, চীন, মেসিডোনিয়া, মাদাগাস্কার, নেপালে শুধুমাত্র নারীরাই সরকারী ছুটির দিনভোগ করেন।]

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040