দারিদ্র্যবিমোচন বিষয়ে কয়েকজন এনপিসি প্রতিনিধি ও তাদের প্রস্তাব
  2017-03-15 09:53:54  cri


চীনে এখনও ৪ কোটির বেশি লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। চীন সরকারের লক্ষ্য, ২০২০ সালের মধ্যে তাদেরকে দারিদ্র্যমুক্ত করা।

দারিদ্র্যবিমোচন বিষয়ে দরিদ্র গ্রামাঞ্চল থেকে আসা জাতীয় গণ কংগ্রেসের (এনপিসি) প্রতিনিধিদের সরাসরি অভিজ্ঞতা আছে। চলতি মাসে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত চীনের দ্বাদশ এনপিসি'র পঞ্চম অধিবেশনে এ ধরনের প্রতিনিধিরা দারিদ্র্যবিমোচন বিষয়ে নিজ নিজ প্রস্তাব তুলে ধরেন। আজকের আসরে আমরা কয়েকজন প্রতিনিধি ও তাদের প্রস্তাব নিয়ে কথা বলবো।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত কুই চৌ প্রদেশ চীনের সবচেয়ে দরিদ্র প্রদেশগুলোর অন্যতম। প্রদেশটিতে দেশের সবচেয়ে বেশি লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বিগত কয়েক বছরে দারিদ্র্যবিমোচনের লক্ষ্যে কুই চৌ অনেক চেষ্টা চালিয়েছে এবং এ অভিশাপ থেকে মুক্তির নিজস্ব কৌশল খুঁজে পেয়েছে। কুই চৌ প্রদেশের কুই ইয়াং শহরের ওয়াং কাং গ্রামের কমিউনিষ্ট পার্টির সম্পাদক ওয়াং হুয়া ছুয়ান জাতীয় গণ কংগ্রেসের প্রতিনিধি এবং তিনি নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। ২০০৭ সালে ওয়াং কাং গ্রামের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ২ হাজার ইউয়ান এবং গ্রামটি ছিল হতদরিদ্র। ওয়াং হুয়া ছুয়ানের নেতৃত্বে শুরু হয় গ্রামটিকে দারিদ্র্যমুক্ত করার কাজ। পর্যাপ্ত হোমওর্য়ার্কের পর ওয়াং হুয়া ছুয়ান গ্রামীণ পর্যটনের মাধ্যমে তার গ্রামটিকে দারিদ্র্যমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। মাত্র দু'বছরে সাফল্য অর্জিত হয়। বর্তমানে গ্রামের লোকজনের বার্ষিক মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ইউয়ানে।

ওয়াং হুয়া ছুয়ান বলেন, ওয়াং কাং গ্রামকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে খালেদা স্ট্রবেরি সমবায়। এ সমবায় সংস্থা গ্রামবাসীর জমি লিজ নিয়ে স্ট্রবেরি চাষ করে। গ্রামবাসীদের কেউ কেউ গোটা প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন এবং মাসিক বেতন পান। এই অভিজ্ঞতার আলোকে এবার এনপিসি অধিবেশনে ওয়াং হুয়া ছুয়ান উত্থাপন করেন 'দারিদ্র্য বিমোচনে কালেকটিভ অর্থনীতির ভূমিকা জোরদার করা' শীর্ষক একটি প্রস্তাব। তিনি বলেন

"শিল্প উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। কালেকটিভ অর্থনীতির উন্নয়নকে দারিদ্র্যমুক্তির একটি মাধ্যম হিসেবে মনে করা হয়।"

ওয়াং কাং একটি সংখ্যালঘু জাতির গ্রামও বটে। ওখানে পু ই নামে একটি সংখ্যালঘু জাতি বসবাস করে। পু ই জাতির সংস্কৃতি রীতিনীতি ও ঐতিহ্যিক খাবার পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারে। ওয়াং ছুয়ান হুয়া মনে করেন, গ্রামীণ পর্যটনের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন করতে চাইলে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে। তিনি বলেন,

"আমরা গ্রামীণ পর্যটন কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে রেখেছি আমাদের জাতির বৈশিষ্ট্যকে। নিজস্ব বৈশিষ্ট্য না-থাকলে গ্রামীণ পর্যটন সফল করা সম্ভব নয়।"

ইউন নান প্রদেশের প্রতিনিধি জি কুই চুর অভিজ্ঞতার সাথে ওয়াং হুয়া ছুয়ানের অভিজ্ঞতার মিল আছে। জি কুই চু 'ই' জাতির একজন তরুণ নারী। তার নেতৃত্বে গ্রামের মেয়েরা জাতির বৈশিষ্ট্যময় সূচিকর্ম করে। ই জাতির সূচিকর্ম চীনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। জি কুই চুর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ই জাতির সূচিকর্ম কমিটি বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক কোম্পানির সাথে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ কোম্পানির মাধ্যমে মেয়েদের হাতে-তৈরি-সূচিকর্ম দেশেবিদেশে বিক্রি হয়। সূচিকর্ম ছাড়া, জি কুই চুর জন্মস্থানে রয়েছে অন্য একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য: 'মে কে'। ই জাতির ভাষায় 'মে' মানে 'মুখ' এবং 'কে' মানে 'প্রাচীন'। 'মে কে' মানে নৃত্য ও গানের মাধ্যমে ই জাতির ইতিহাস, সমাজ, জীবনযাপন প্রণালী তুলে ধরা। মে কে'র একজন উত্তরাধিকারী হিসেবে জি কুই চু মনে করেন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য একদিকে কৃষককে নিজস্ব ব্যবসা দাঁড় করাতে সাহায্য করে এবং অন্যদিকে পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। জি কুই চু বলেন, দারিদ্র্যবিমোচন ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ পরস্পরের পরিপূরক।

আলোচ্য দুটি গ্রাম নিজ নিজ বেশিষ্ট্য ও প্রাধান্যকে কাজে লাগিয়ে শিল্প উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্যের কবল থেকে মুক্ত হয়েছে।

অন্যদিকে, কুই চৌ প্রদেশের অন্য একটি দরিদ্র গ্রাম অবস্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে দারিদ্র্যমুক্তির পথ খুঁজে পায়। ২০১৪ সালে মা লাং গ্রাম ও অন্য দুটি গ্রামের বাসিন্দারা একসাথে নতুন একটি জায়গায় স্থানান্তরিত হয় এবং নতুন একটি কমিউনিটি প্রতিষ্ঠা করে। মা লাং গ্রামের প্রধান লিউ ছিয়াও ইং বলেন,

"নতুন কমিউনিটি খুব সুন্দর। পাহাড়ের পাশে স্থাপিত কমিউনিটিতে বিভিন্ন জাতির মানুষ নিজ নিজ সংস্কৃতি অনুসারে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বাড়িঘর নির্মাণ করেছে। এখানে হুই হু, পু ই ও মিয়াও জাতির বৈশিষ্ট্যময় বাড়িঘর নির্মিত হয়েছে।"

অবশ্যই নতুন একটি জায়গায় আসা মানে দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসা নয়। এর প্রসঙ্গে লিউ ছিয়াং ইং বলেন, "আমাদের গ্রামীবাসীর প্রথম চিন্তা ছিল, পাহাড় থেকে বাইরে এসে তারা কীভাবে জীবনযাপন করবেন। তখন আমার পরামর্শ ছিল, সরকারের সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত কোনো কোম্পানি আমাদের জমিগুলো ভাড়া নিতে পারে।"

রাষ্ট্রীয় পরিষদের দারিদ্র্যবিমোচন কার্যালয়ের পরিচালক লিউ ইউং ফু বলেন, বর্তমানে চীনে অন্তত এক কোটি দরিদ্র লোককে নতুন জায়গায় স্থানান্তর করতে হবে। তারা বর্তমানে যেখানে বসবাস করে সেখানে প্রাকৃতিক পরিস্থিতি খুব খারাপ এবং পরিবেশও নাজুক। এখানকার উত্পাদন-প্রক্রিয়ায় প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অথচ বাসিন্দারা দারিদ্র্যমুক্ত হতে পারছে না। তবে, এক কোটি লোককে স্থানান্তরিত করা সহজ কাজ নয়। কিন্তু চীন সরকার এ কাজটি সম্পন্ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থান সৃষ্টিও চীনের সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ এবং গণকংগ্রেস প্রতিনিধিদের আলোচ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সান সি প্রদেশের হে ইয়াং জেলার নান লিয়ান গ্রামের প্রধান লেই ওয়েন ফাং তাদের অন্যতম। নান লিয়ান গ্রামে কয়লাসম্পদ প্রচুর এবং গ্রামে বিদ্যুত উত্পাদন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে গ্রামবাসীদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রস্তাব দেন লেই ওয়েন ফাং।

তিনি বলেন, "কয়লাসম্পদ উন্নয়ন করে প্রায় ১ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব।"

২০১৬ সালে চীনে এক কোটি ২৪ লাখ মানুষ দারিদ্রের কবল থেকে মুক্তি পায়। আর চলতি বছর আরও এক কোটি মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে চীনা সরকার। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040