গত বছর চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ঐতিহাসিক বাংলাদেশ সফরের পর দুদেশের সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারিত্বে পৌঁছায়, গতি পায় দুদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনয়োগসহ সার্বিক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক। এরই ধারাবাহিকতায় গত সপ্তাহে চীনের দুটি উচ্চ পর্যায়ের বাণিজ্যিক প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে। এর একটি হচ্ছে চায়না বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালস ফেডারেশন (সিবিএমএফ) আর অন্যটি হচ্ছে অল চায়না ফেডারেশন অব ইন্ডাস্ট্রি এন্ড কমার্স। দুটি সংগঠনই বাংলাদেশে বড় অংকের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
চীনের ৬ হাজার ৬০০ বিনিয়োগকারীর সমন্বয়ে গঠিত সিবিএমএফের প্রতিনিধি দলটি ২৫ এপ্রিল বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ- বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলামের সঙ্গে বৈঠক করে বিনিয়োগের আগ্রহের কথা জানায়। পরদিন অর্থাৎ ২৬ এপ্রিল দুপক্ষের মধ্যে ২০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশের পক্ষে বিডার পরিচালক তৌহিদুর রহমান খান ও চীনের সিবিএমএফের পক্ষে এর পরিচালক দিং লী জং চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
বাংলাদেশে ভবন নির্মাণ উপকরণ খাতে চীনের সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং এ খাতে দক্ষ ও পেশাদার জনবল ও অবকাঠামো তৈরির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে সমঝোতাস্মারকটি স্বাক্ষরিত হয়। এর আওতায় চীনের সংস্থাটি ব্রিকস, টাইলস, সিমেন্ট, সিরামিক, মোজাইক প্রভৃতি খাতে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে। বাংলাদেশের বিনিয়োগ সংস্থা বিডা চীনা বিনিয়োগকারীদের এ সংক্রান্ত পলিসি, ইউটিলিটি ও ওয়ানস্টপ সার্ভিস দিয়ে সহায়তা করবে।
চীনের ভাইস মিনিস্টার ছুয়ান চ্যচু'র নেতৃত্বে অল চায়না ফেডারেশন অব ইন্ডাস্ট্রি এন্ড কমার্সের একটি প্রতিনিধিদল একই সময়ে বাংলাদেশ সফর করে। প্রতিনিধিদলটি ২৭ এপ্রিল বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই'র সঙ্গে রাজধানী ঢাকায় বৈঠক করে। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন এফবিসিসিআই'র সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমেদ। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিনিয়োগবান্ধব উল্লেখ করে এফবিসিসিআই সভাপতি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প, দুগ্ধ খামারসহ বিশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে চীনা প্রতিনিধিদলের প্রতি আহ্বান জানান। গণপরিহবনেও চীন বিনিয়োগ করতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার ও এফবিসিসিআই এ ক্ষেত্রে সহায়তা দেবে। প্রয়োজনে চীন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা আলাদভাবে এ বিনিয়োগ করতে পারে।
চীনা প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে যোগ দেন ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত মা মিংছিয়াং। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন উন্নয়নের দিকে রয়েছে। এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ কিছু কিছু ক্ষেত্রে চীনের চেয়েও এগিয়ে রয়েছে বলে জানান চীনা রাষ্ট্রদূত। বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে চীন বর্ধিত হারে যুক্ত হতে পারলে দুদেশের আন্তঃবাণিজ্য আরো বাড়বে বলে আশাবাদ প্রকাশ করেন মা মিংছিয়াং।
বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্সে ১৭৬ নম্বরে থাকা বাংলাদেশকে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটিয়ে ১০০'র মধ্যে নিয়ে আসতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম। এতে করে দেশিয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন। এদের মধ্যে অন্যতম চীনের সিবিএমএফ ও অল চায়না ফেডারেশন অব ইন্ডাস্ট্রি এন্ড কমার্স।
আশার কথা চীনের পাশাপাশি ব্যাপক হারে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে। আড়াই বছর আগে সরকার বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে যে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিল তাতে ভালো ফলাফল আসতে শুরু করেছে। এর মধ্যে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে ৭৬টি অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নের কাজ চলছে পুরোদমে। প্রস্তুতির শেষ পর্যায়ে রয়েছে ২৩টি- যাতে এরই মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ আসতে শুরু করেছে।
ভূমি উন্নয়ন এবং আনুষঙ্গিক অবকাঠামোর কাজ শেষ করায় মেঘনা, আব্দুল মোনেম, আমান ও বে অর্থনৈতিক অঞ্চলকে চূড়ান্ত লাইসেন্স দিয়েছে অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ-বেজা। সংস্থাটির নির্বাহী চেয়ারম্যানপবন চৌধুরী জানান, তাদের কাছে বড় অংকের বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব রয়েছে। বে- বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউর রহমানও জানান, এরই মধ্যে তারা বড় অংকের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছেন।
আগামী ১৫ বছরের মধ্যে ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ ও ৪০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে বেজা। এর মাধ্যমে এক কোটি লোকের কর্মসংস্থান হবে বলে আশা সরকারের। বিশ্লেষকরা বলছেন যথাযথভাবে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে নিতে পারলে চীনসহ অন্যান্য বিদেশি বিনিয়োগ আরো বর্ধিত হারে আসবে এবং এতে করে বেজার লক্ষ্যপূরণ অসম্ভব হবে না।
ঢাকা থেকে মাহমুদ হাশিম।