পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দর: 'এক অঞ্চল, এক পথ' উদ্যোগের ফসল
  2017-05-06 20:30:04  cri

৩৫ বছর বয়সী হু ইয়াও চং হলেন চীনের চিয়াসি প্রদেশের শেনচেনের বাসিন্দা। আর ৩৮ বছর বয়সী কু সং থাও থাকেন লন্ডনে, তবে তার জন্মস্থান চীনের থিয়ানচিন। গত ২২ মার্চ তাঁরা পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত গোয়াদার বন্দরে একসঙ্গে লাঞ্চ খান এবং ব্যবসা নিয়ে আলোচনা করেন। কু সং থাও লন্ডনে 'নো লোগো' নামক একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক। তার প্রতিষ্ঠানে ট্র্যাক বাইক (Track Bike) উত্পাদন করা হয়। তাঁর প্রতিষ্ঠানে উত্পাদিত ট্র্যাক বাইক ইউরোপের বাজারের ৫ শতাংশ দখল করে আছে। তাঁর প্রতিষ্ঠানের কারখানা চীনের থিয়ানচিনে অবস্থিত। তিনি পাকিস্তানের গোয়াদারেও একটি কারখানা নির্মাণ করতে চান। কেন তিনি গোয়াদারে কারখানা নির্মাণ করতে চান? এ প্রশ্নের উত্তরে কু সং থাও বলেন, "প্রথমত, পাকিস্তানে শ্রমের মূল্য কম। থিয়ানচিনে একজন শ্রমিকের মাসিক বেতন সাধারণত ৩ হাজার ইউয়ান আরএমবি, কিন্তু পাকিস্তানে শ্রমিকের বেতন তার মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ; দ্বিতীয়ত, ইউরোপে চীনে উত্পাদিত ট্র্যাক বাইক-এর ওপর ডাম্পিং-বিরোধী কর আরোপ করা হয়; তৃতীয়ত, পাকিস্তানে কাঁচামাল তুলনামূলকভাবে সস্তা এবং পাকিস্তানিরা চীনাদের তুলনায় ইংরেজি ভাষা ও ইউরোপীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে বেশি জানে। সেজন্য আমার মনে হয়, এখানে বিনিয়োগ করলে বেশি সুবিধা হবে।"

গোয়াদার বন্দর অবাধ বাণিজ্য অঞ্চল কোম্পানির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হু ইয়াও চং। তিনি গত বছর কু সং থাওয়ের মতো সহস্রাধিক সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীকে এখানে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।

গোয়াদার বন্দরটি বছরের পুরো সময় জুড়ে বরফ-মুক্ত থাকে। বন্দরটি থেকে বিখ্যাত হরমুজ প্রণালী মাত্র ৪শ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ২০১৩ সালে পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে গোয়াদার বন্দরের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব চীনের বিদেশি বন্দর কোম্পানিকে প্রদান করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২২ সাল নাগাদ গোয়াদার বন্দর দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম বন্দরে পরিণত হবে। এখানে বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীদের জন্য সুযোগ প্রচুর।

অথচ ২০১৪ সালেও বন্দরটিতে কোনো চীনা স্থায়ীভাবে বাস করতো না। তখন বন্দরটিতে কয়েক মাসেও একটি জাহাজ আসতো কি না সন্দেহ। এখানকার অবাধ অঞ্চলে তখন বহু পতিত জমি ছিল। বন্দরটির একমাত্র পাঁচ তারকা হোটেলেও সবসময় বিদ্যুত্ থাকতো না।

২০১৫ সালের অগাষ্ট মাসে হু ইয়াও চং পাকিস্তানে আসেন। ২০১৬ সালে পাকিস্তান সরকার 'অর্থ আইন, ২০১৬' প্রকাশ করে। এ আইনে দেশটিতে বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ করমুক্ত সুবিধার ব্যবস্থা রাখা হয়। একই বছরে পাক নৌবাহিনী বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে গোয়াদার বন্দরের কাছাকাছি অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। ২০১৬ সালে গোয়াদার বন্দরের প্রাথমিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় এবং নির্মাণকাজ শুরু হয়। বন্দরটিতে আশানুরূপ বিনিয়োগও আকৃষ্ট হয়। চলতি বছরে মোট ৯টি বিদেশি প্রতিষ্ঠান গোয়াদার বন্দরে ২০০ কোটি ইউয়ানেরও বেশি বিনিয়োগ করে। এ ছাড়া, চীনের আরও ১৬টি প্রতিষ্ঠান বন্দরটিতে বিনিয়োগ করার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তারা সেখানে বিনিয়োগ করবে ৩০০০ কোটি ইউয়ান। অবাধ অঞ্চলে বিনিয়োগ সংগ্রহ কাজের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে হু ইয়াও চং বলেন, "প্রাথমিক উন্মুক্ত অঞ্চলের নির্মাণকাজের ৬০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। এ বছরের শেষ নাগাদ সকল র্নিমাণকাজ শেষ হবে। অথচ শুরুতে প্রাথমিক উন্মুক্ত অঞ্চলের নির্মাণকাজ তিন বছরে এবং অবাধ অঞ্চলের নির্মাণকাজ ১৫ বছরে শেষ হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। এখন আমার মনে হয়, এত বেশি সময় লাগবে না।"

গোয়াদার বন্দরকে কেন্দ্র করে নতুন মহাসড়ক, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ৩ লাখ কিলোওয়াট বিদ্যুতকেন্দ্র, ও সমুদ্রের পানিকে লবণমুক্ত করার কারখানাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে বা হবে।

গোয়াদার বন্দর ও সংশ্লিষ্ট অবাধ বাণিজ্য অঞ্চল হচ্ছে 'এক অঞ্চল, এক পথ' উদ্যোগের আওতায় 'চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর'-এর ফ্ল্যাগশিপ পরিকল্পনা। পাক প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরিফ গোয়াদার বন্দরকে গোটা বিশ্বের অর্থনীতির সাথে তার দেশের অর্থনীতির সংযোগসেতু হিসেবে গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছেন; তিনি চান একটি স্মার্ট বন্দর। এ সম্পর্কে গোয়াদার বন্দর ব্যুরোর মহা-পরিচালক মুনির আহমাদ জান বলেন, "চীনের শেনচেন আমাদের আদর্শ। কারণ, ৩০ বছর আগেও শেনচেন ছিল একটি ছোট গ্রাম। কিন্তু এখন শেনচেন একটি স্মার্ট শহরে পরিণত হয়েছে।"

হু ইয়াও চং ২০০৮ সালে শেনচেনে আসেন। কারণ, তার স্ত্রী সেখানে কাজ করতেন। তিনি বলেন, শেনচেন ও গোয়াদার—দুটোই বন্দরভিত্তিক শহর। দুই শহরেরই বন্দর উন্নয়নের ভিত্তি আছে। দু'দেশের সরকার দুই শহরের উন্নয়নে নীতিগত ও আর্থিক সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু শেনচেনের সুবিধা হল, এটি হংকংয়ের কাছাকাছি অবস্থিত। অন্যদিকে গোয়াদার বন্দরের কোনো আধুনিক প্রতিবেশী নেই। সেজন্য গোয়াদার বন্দর উন্নয়নের বৈশিষ্ট্যময় পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন,

"গোয়াদার বন্দরের কাছাকাছি অঞ্চলের অর্থনীতি উন্নত না। সেজন্য আমাদের লক্ষ্য বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করা। শিল্পব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আস্তে আস্তে আমরা বন্দর উন্নয়ন করবো। বন্দরের কাছাকাছি অবাধ শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত এ কারণেই। এ ক্ষেত্রে উন্নয়নের সাফল্য বন্দর উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। এর মাধ্যমে পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলও উন্নত হবে। ভবিষ্যতে এ বন্দরটি আফগানিস্তান ও মধ্য-এশিয়ার দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ বন্দরে পরিণত হবে।"

চলতি বছর হল শেনচেন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ৩৭তম বার্ষিকী। হু ইয়াও চং মনে করেন, গোয়াদার বন্দর ৩ বছর পর শেনচেনের চেয়েও ভালো অবস্থানে পৌঁছাবে। কারণ, সেনচেন যখন গড়ে উঠছিল, তখন চীনের অর্থনীতি অনুন্নত ছিল এবং সেখানে কোনো বিদেশি বিনিয়োগ ছিল না। অথচ 'এক অঞ্চল, এক পথ' উদ্যোগের আওতায় চীন ও পাকিস্তান যৌথভাবে গোয়াদার বন্দর উন্নয়নের কাজ করছে। তা ছাড়া, চীন-পাকিস্তান সম্পর্কও অনেক ভালো। তাই গোয়াদার বন্দর উন্নয়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঝুঁকি প্রায় নেই বললেই চলে। পাশাপাশি চুক্তি অনুযায়ী গোয়াদার বন্দরে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সুবিধাও ভোগ করবে; যেমন, ২৩ বছরের করমূক্ত সুবিধা, ৯৯ বছরের ইজারা, শতভাগ মুনাফা নিজ দেশে নিয়ে যাওয়ার সুবিধা ইত্যাদি তারা পাবে। এ সম্পর্ক হু ইয়াও চং বলেন, "বিশ্বে অনেক অবাধ বাণিজ্য অঞ্চল রয়েছে; যেমন, শাংহাই, থিয়ানচিন, কেনিয়া, ইথিওপিয়া ও চিলি ইত্যাদি। কিন্তু গোয়াদার অবাধ অঞ্চলে করমুক্ত মেয়াদ সবচেয়ে দীর্ঘ। ২৩ বছর করমুক্ত সুবিধা পাওয়া একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।"

গোয়াদার বন্দরের ভৌগোলিক সুবিধাও আছে। গোয়াদার বন্দর আফগানিস্তান ও মধ্য-এশিয়ার কাছাকাছি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে। তাই আশা করা যায়, ভবিষ্যতে এ বন্দর একটি আঞ্চলিক প্রভাবশালী ট্রানশিপমেন্ট বন্দরে পরিণত হবে।

বর্তমানে গোয়াদার বন্দরের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নিরাপত্তা। বন্দরটি অবস্থিত বালুচিস্তান প্রদেশে, যেখানে অধিকাংশ অঞ্চলই অনুন্নত। সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী তত্পরতা প্রকট। এ ছাড়া, একাধিক সন্ত্রাসী সংস্থাও এখানে তত্পর। 'চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর' নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার পর একশ্রেণির অপশক্তি চীনাদের ওপর হামলা চালিয়ে দু'দেশের সম্পর্ক নষ্টের প্রয়াস চালিয়েছিল। তাঁদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল পাক সরকারের ওপর আঘাত হানা। এ সম্পর্কে গোয়াদার পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা মিস্টার শামিল বলেন, "স্থানীয় সন্ত্রাসী জঙ্গির সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। তারা অধিকাংশই দরিদ্র। বাইরের সন্ত্রাসী সংস্থাগুলো তাদেরকে ঘুষ দিয়ে সক্রিয় রেখেছে। আমরা তাঁদের অপতত্পরতার ওপর নজর রাখছি। আমরা অবশ্যই তাদেরকে দমন করতে সক্ষম হবো।"

চীনা প্রতিষ্ঠান আসায় স্থানীয়দের পুরনো ব্যবসা খানিকটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। এ কারণেও তারা বিরোধিতা করছিল। তবে তাদের ক্ষোভ প্রশমনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে; যেমন, স্থানীয় নাগরিকদের জন্য স্কুল নির্মাণ করা হয়েছে, তাদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে, ইত্যাদি। এ সম্পর্কে হু ইয়া চং বলেন, "আমি মনে করি, স্থানীয় লোকজনের ভবিষ্যত উজ্জ্বল। তাঁরা হোটেল ব্যবসা করে যথেষ্ট আয় করতে পারবে। কারণ, অধিক থেকে অধিকতর বিদেশি বিনিয়োগ গোয়াদার বন্দরে আসবে।"

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040