লিসু জাতির লুও ফু হুয়া প্রতিষ্ঠান: 'হুওছাও' কাপড় তৈরির মাধ্যমে সুখী জীবন গড়ার গল্প
  2017-12-22 13:48:09  cri

চীনের ইউননান প্রদেশের তালি জেলার তাইং থানার হে গ্রামে লিসু জাতির বৈশিষ্ট্যময় একটি কাঠের ঘর আছে। ঘরটি লিসু জাতির নারী লুও ফু হুয়া'র বাড়ি ও হোটেল। তিনি হুওছাও কাপড় উত্পাদন কোম্পানিও গড়ে তুলেছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "গ্রামে আমিই প্রথম হোটেল দিয়েছি। এখন আমার ব্যবসা খুবই ভাল। এর আগে আমি ভুট্টা চাষ করতাম। তখন আমার প্রতিবছরে আয় মাত্র ২ থেকে ৩ হাজার ইউয়ান আরএমবি। তখন আমার পরিবার ছিল খুবই দরিদ্র।"

পিনছুয়ান জেলায় লিসু জাতি হচ্ছে ইউননান প্রদেশের ৯টি 'সরাসরি পরিবর্তিত' জাতির একটি। 'সরাসরি পরিবর্তিত' জাতি বলতে বোঝায় সেসব জাতিকে যারা গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে আদিম সামাজিক ব্যবস্থা থেকে সরাসরি সমাজতান্ত্রিক সমাজে পরিবর্তিত হয়েছে। ইতিহাস ও প্রকৃতির কারণে এসব জাতির বাসিন্দাদের জীবনমান ছিল খুবই নিম্নমানের। তাঁরা সাধারণভাবেই ছিল গরিব। ২০১১ সালে পিনছুয়ান জেলায় বৌদ্ধ মন্দিরসম্বলিত জিজু পাহাড়ে সড়ক নির্মিত হয়। এতে এলাকার পরিবহন-ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটে। এর মাধ্যমে এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য পর্যটন-ব্যবসা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

বৌদ্ধ মন্দিরসম্বলিত জিজু পাহাড়ের কাছাকাছি অবস্থানের জন্য লুও ফু হুয়া'র হোটেলের চাহিদা বেশি। সারা চীন থেকে আসা পর্যটকরা তার হোটেলে থাকেন। এমনকি বিদেশ থেকে পর্যটকরা এসেও তার অতিথি হন। অতিথিদের পরামর্শের ভিত্তিতে তিনি হোটেলের রেস্তোরাঁর খাবার উন্নত করেন। এ ছাড়া, তিনি হোটেলের লবিতে তাঁতকল রেখে দিয়েছেন। যখন অতিথিদের ভিড় কম থাকে, তখন তিনি কাপড় বুনেন। হাতে-বোনা-কাপড় লিসু জাতির নারীদের ঐতিহ্যগত শিল্প। বর্তমানে তাদের জীবনমান অনেক উন্নত হয়েছে। কিন্তু তাঁরা এ ঐতিহ্যগত শিল্পকে হারিয়ে যেতে দেননি। লু ফু হুয়া লিসু জাতির ঐতিহ্যগত হুওছাও কাপড় বোনেন। তিনি প্রথমে নিজের পরিবারের জন্য কাপড় বুনতেন। কিন্তু অনেক পর্যটক হুওছাও কাপড়ের ব্যাপারে আগ্রহী। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "শুরুর দিকে আমি শুধু নিজের পরিবারের জন্য কাপড় বুনতাম। কিন্তু অনেক পর্যটক আমার নিজের হাতে-বোনা-কাপড় পছন্দ করেন। সেজন্য আমি আস্তে আস্তে কাপড় বিক্রির ব্যবসাও শুরু করি।"

লুও ফু হুয়া জানালেন 'হুওছাও' হচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের একধরনের সাধারণ ঘাস। প্রাচীনকাল থেকে লিসু জাতির নারীরা এ ঘাস দিয়ে কাপড় তৈরি করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন। এ প্রযুক্তি এখনও জনপ্রিয়। তারা হুওছাও ঘাসের পাতা দিয়ে লিসু জাতির বৈশিষ্ট্যময় কাপড় তৈরি করেন। কিন্তু হুওছাও কাপড় তৈরির প্রক্রিয়া খুবই জটিল। সাধারণত কয়েক মাস লেগে যায় একটি কাপড় বুনতে। কিন্তু এ ধরনের কাপড় খুবই টেকসই। এ ছাড়া, হুওছাও এক ধরনের চীনা ঔষধ। সেজন্য এ ধরনের কাপড়ের দাম কম না।

একবার স্থানীয় সরকারের সুপারিশে লুও ফু হুয়া খুংমিংয়ে আয়োজিত ইউননান মেলায় অংশ নেন। মেলায় একজন ব্যবসায়ী তাঁর সঙ্গে ২০ হাজার ইউয়ান আরএমবি'র চুক্তি স্বাক্ষর করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ২০ দিনের মধ্যে ২০টি পোষাক তৈরি করতে পারেন না লুও ফু হুয়া একা। সেজন্য তিনি চুক্তিটি করেননি। কিন্তু মেলায় অংশগ্রহণ করে তিনি হুওছাও কাপড়ের ব্যবসার সুযোগ আবিষ্কার করেন। তিনি গ্রামে ফিরে আসার পর গ্রামের নারীদেরকে সংগঠিত করে ২০১৭ সালে পিনছুয়ান জেলার লিসু জাতির হুওছাও কাপড় উত্পাদন কোম্পানি গড়ে তোলেন। আস্তে আস্তে জিজু পাহাড়ের কাছাকাছি চারটি গ্রামের একশ'রও বেশি বাড়ি তাঁর সঙ্গে কাপড় উত্পাদন শুরু করে। এর ফলে গ্রামবাসীদের আয় অনেক বেড়েছে।

এখন কোম্পানিটি নিয়মিত গ্রাহকদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু লুও ফু হুয়া বর্তমান সাফল্যে সন্তুষ্ট নন। ঐতিহ্যগত হুওছাও পোষাকের বৈশিষ্ট্য রয়েছে, কিন্তু আড়ম্বরপূর্ণ শৈলী নেই। সেজন্য ঐতিহ্যগত হুওছাও পোষাক বিক্রির পরিমাণ বেশি না। লুও ফু হুয়ার মেয়ে হাই হুই চেন শহরে কাজ করতেন। তিনি হুওছাও কাপড় তৈরির পদ্ধতি উন্নয়নের জন্য বাড়িতে ফিরে আসেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "আসলে বর্তমান তরুণ-তরুণীরা শহরে কাজ খুঁজতে আগ্রহী। তারা সাধারণত নিজেদের সংস্কৃতির ওপর গুরুত্ব দেয় না। আমার মনে হয়, নিজের জাতির সংস্কৃতি সবচেয়ে মূল্যবান। লিসু জাতির মেয়ে হিসেবে আমার নিজের জাতির কাপড় তৈরি করা শেখা উচিত। আমার গ্রামের নানী, আন্টি ও বড় বোন সবাই আমাকে সাহায্য করেন।"

শুরুর দিকে শহর থেকে গ্রামে ফিরে আসার সময় হাই হুই চেন তেমন কিছু করতে আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু শেষমেষ তিনি বুঝতে পারেন তার দায়িত্ব। তিনি মার উত্সাহে খুবই কম সময়ে কাপড় তৈরির উপায় শিখেছেন। এ ছাড়া, তিনি সবসময় সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে লিসু জাতির সংস্কৃতি প্রচার করে থাকেন। সম্প্রতি তিনি কোম্পানিটির নির্বাচনে সাংস্কৃতিক শিল্প বিভাগের পরিচালক নির্বাচিত হন। তিনি বলেন, হুওছাও কাপড়কে টিকিয়ে রাখতে সরকারের সমর্থনের পাশাপাশি নিজেদেরও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত।

স্থানীয় সরকার লুও ফু হুয়া ও হাই হুই চেন'র ঐতিহ্যগত শিল্পের সাথে দারিদ্র্যবিমোচন প্রক্রিয়াকে সংযুক্ত করার পদ্ধতি সমর্থন করে। পিনছুয়ান জেলার তাইং থানার সরকার একদিকে বিভিন্ন সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাইরে হুওছাও সংস্কৃতি প্রচার করে, অন্যদিকে হুওছাও শিল্পের জন্য প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার চেষ্টা করে। থানাটি ২০১৬ সাল থেকে প্রতিবছর লিসু জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খুওশি উত্সব আয়োজন করে আসছে। উত্সবের মাধ্যমে তাঁদের সংস্কৃতি ও শিল্প প্রচার করা হয়।

বর্তমানে মা ও মেয়ে দিনের অধিকাংশ সময় লিসু জাতির ঐতিহ্যগত পোষাকের ডিজাইন ও প্রচারের কাজ করে থাকেন। তাঁরা বিভিন্ন ভোক্তা গ্রুপকে বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি করেন। পরবর্তী ধাপে তাঁরা ই-কমার্স উন্নয়ন করবেন এবং ওয়েবসাইটে নিজেদের পণ্যদ্রব্য বিক্রি করবেন। লুও ফু হুয়া হুওছাও'র কৃত্রিম উত্পাদনের ওপরও নজর দিয়েছেন। প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে প্রতিবছর হুওছাও উত্পাদিত হয় কম। এ সম্পর্কে হাই হুই চেন বলেন, "আমি আশা করি, আমার মা'র সিদ্ধান্ত ঠিক। বর্তমানে আমাদের বড় লক্ষ্য হচ্ছে, পিনছুয়ান জেলায় লিসু জাতির অর্থনীতির উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা। আমরা পাহাড়ি অঞ্চলে থাকি, কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি অনেক সমৃদ্ধ।"

লুও ফু হুয়া ও তাঁর মেয়ে ভবিষ্যতে নিজেদের শিল্প ও ব্যবসা আরও উন্নত করতে চান। তিনি বলেন, "আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, ঐতিহ্যগত শিল্প টিকিয়ে রাখা ও এর প্রচার করা, যাতে লিসু জাতির আরও বেশি নারীর জীবনমান উন্নত করা যায়।"

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040