বেইজিংয়ে আয়োজিত চীনের বাধ্যতামূলক শিক্ষাবিষয়ক ফোরামে বিশেষজ্ঞদের নানান আলোচনা (২)
  2018-01-08 15:54:03  cri


বন্ধুরা, গেল ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে আমরা বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত চীনের শিক্ষাবিষয়ক ফোরামে উত্থাপিত কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতামত তুলে ধরেছি। আজকের অনুষ্ঠানে এ ফোরামের আলোচ্য বিষয় নিয়ে আরো কিছু তথ্য তুলে ধরবো।

চীনের নতুন 'কাও খাও' অর্থাত্ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সংস্কার সম্পর্কে চীনের হুয়াতুং নর্মাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রশিক্ষণ একাডেমির প্রধান অধ্যাপক চৌ বিন তাঁর চিন্তাভাবনা তুলে ধরেন। তিনি উচ্চ বিদ্যালয়ে কয়েক বছর শিক্ষকতা করেছেন। তিনি বলেন, 'কাও খাও'-র পুরনো ও নতুন ব্যবস্থার তুলনামূলক পার্থক্য হল: পুরনো ব্যবস্থায় শিক্ষা বিভাগের শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের বাছাইয়ের বিষয় সমাধান করা হয় আর নতুন ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয় বাছাইয়ের বিষয় সমাধান করা হয়। শুধু তথাকথিত ভালো ও শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া নয়, এ ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা ইচ্ছা মতো নিজের প্রিয় মেজর বাছাই করতে পারেন। অতীতে সবাই পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় ও ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির হার পরিমাপ করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাদানের মান বিবেচনা করতো। এর ফলে অনেক শিক্ষার্থী নিজের প্রাধান্য ছেড়ে দিয়ে সবার কাছে শ্রেষ্ঠ এমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হতো, তবে এমন সিদ্ধান্ত নিজের ভবিষ্যত উন্নয়নে তেমন বড় কোনো কল্যাণ বয়ে আনে নি।

এ সম্পর্কে অধ্যাপক চৌ মনে করেন, 'কাও খাও' ব্যবস্থা ধাপে ধাপে পরিবর্তন করতে হবে, হঠাত্ বড় পরিবর্তন ঘটলে সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। যেমন, চীনের শাংহাই ও চেচিয়াং প্রদেশে মেজর বাছাই করার পর বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই করার সংস্কার চালু করা হয়েছে। এর ফলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় মেজর উন্নয়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়। নতুন 'কাও খাও' ব্যবস্থায় মেজর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ মানের ওপর নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। কারণ শ্রেষ্ঠ মেজর হবে দক্ষ ব্যক্তি প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয় বিষয়। সংশ্লিষ্ট সংস্কার নতুন 'কাও খাও' ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে বন্ধ হবে না। অতীতে শিক্ষার্থীরা অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করতো, তবে তাদের নিজেদের বাছাইয়ের অধিকার ছিলো না। এখনো শিক্ষার্থীরা কষ্ট করে লেখাপড়া করছেন, তবে এখন তাদের বাছাইয়ের অধিকার রয়েছে। তাছাড়া, মেজর বাছাই করার বিষয়টি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার সাথে জড়িত। তাই বিভিন্ন সংস্কার শিক্ষার্থীদের গভীর ভাবনার সাথে জড়িত।

২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর চীনের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের 'গ্রুপ ভ্রমণ ও সামাজিক অনুশীলন সম্পর্কে নির্দেশনা' প্রকাশ করে চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ নির্দেশনা থেকে বোঝা যায়, চীনের শিক্ষাদান উন্মুক্তকরণের পথে চলে এসেছে।

এখন জানতে হবে এই গ্রুপ পর্যটন ও সামাজিক অনুশীলন কি?

আসলে এটি হলো সংশ্লিষ্ট স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন লেখাপড়ার বিষয় অনুযায়ী গ্রুপ পর্যটন ও থাকা-খাওয়া আয়োজন করা, স্কুলের বাইরে ভিন্ন জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান সম্প্রসারণ করানো, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সংস্কৃতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ করা, যাতে সামাজিক নৈতিকতা অনুভব করা যায় ও শিক্ষার্থীদের আত্মশাসন, নব্যতাপ্রবর্তন ও অনুশীলনের দক্ষতা বাড়ানো যায়।

এ নির্দেশনার প্রকাশ যেন শান্ত হ্রদের মধ্যে একটি পাথর নিক্ষেপ করার মতো। কারণ বিভিন্ন ধরনের পর্যটন, ক্যাম্প শিক্ষাদান ও স্কুলের বাইরে লেখাপড়া শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাসের পাশাপাশি প্রাকৃতিক পরিবেশে ও বহিরাঙ্গনে জ্ঞান অর্জনের জন্য সহায়ক। এভাবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হয়, অভিজ্ঞতা বাড়ে ও জীবনের নানান কাজে উত্সাহ তৈরি হয়। এর মধ্য দিয়ে তাদের অনুসন্ধান, কল্পনা, পর্যালোচনা ও নব্যতাপ্রবর্তনের চেতনা বাড়ে এবং গ্রুপ সহযোগিতা ও যোগাযোগের দক্ষতাও জোরদার হয়।

গ্রুপ পর্যটন ও সামাজিক অনুশীলনের তাত্পর্য নিয়ে ফিনল্যান্ডের ওয়েং লিননা শহরের ডেপুটি মেয়র ও আন্তর্জাতিক শিক্ষা কেন্দ্রের পরিচালক ড. মার্কু কানকুনেন মনে করেন, বহিরাঙ্গনের কার্যক্রমের কিছু তাত্পর্য রয়েছে। সাধারণ শিক্ষাদানে ফিনল্যান্ডের শিক্ষার্থীদের এমন কার্যক্রম ব্যাপক, তবে এর পূর্বশর্ত হল শিক্ষার্থীদের নিজস্বভাবে যাওয়ার আগ্রহ তৈরি করা, তা বাধ্যতামূলকভাবে করলে হবে না। ক্যাম্প শিক্ষা বা ক্লাসরুমের বাইরে যে শিক্ষা তা উভয়ই হল বাচ্চাদের অনুশীলন ও অনুভূতিতে নিজের পদ্ধতিতে জ্ঞান অর্জন করা। শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জন করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া ঠিক নয়। ফিনল্যান্ডের একটি প্রবাদে বলা হয়, 'বেশি তুলনা করা ভালো নয়'। তার মানে অতিরিক্ত জ্ঞানার্জন করলে বোঝার জিনিস কমে যাবে। তাই বাধ্যতামূলকভাবে বাচ্চাদের জ্ঞান অর্জন নয়, লেখাপড়ার ভিত্তি হবে বোঝাবুঝি।

থিয়েটারের প্রভাবসম্পর্কিত বিষয়ে ড. মার্কু মনে করেন, একজন পিতা বা মাতা তা পরিবর্তন করতে সক্ষম নয়, তবে ব্যাপক পিতামাতার পক্ষে একসাথে তা পরিবর্তন করা সম্ভব। ফিনল্যান্ডও চীনের মতো শিক্ষা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। এর পর দেশে সংশ্লিষ্ট সংস্কার চালু হয়, স্কুল, কমিউনিটি, পিতামাতা ও ছাত্রছাত্রীরা প্রত্যেক সেমিস্টারের আগে ক্লাস নিয়ে আলোচনা করেন। এখানে সংশ্লিষ্ট ক্লাসের বিষয় আগে থেকে ঠিক করা। পিতামাতাকে অবশ্যই শিক্ষাদানে অংশগ্রহণ করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের একটি হাই স্কুলের প্রধান মিস্টার সামার সিগলার মনে করেন, চীনের কিছু কিছু পিতামাতা হয়তো নিজের সন্তানকে একটি শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করার জন্য অনেক উদ্বিগ্ন থাকেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের প্রবাসীরা রয়েছেন, তাই এখানে পিতামাতাদের চিন্তাভাবনাও ভিন্ন। এখানে প্রযুক্তি মেরামতের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন চাকরি আছে। এই চাকরির জন্য কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি দরকার নেই এবং এমন লোকদের বেতনও সাধারণ স্নাতকদের চেয়ে অনেক বেশি। তবে এ ক্ষেত্রে পেশাদার প্রযুক্তিগত বিদ্যালয় থেকে সংশ্লিষ্ট পেশাগত যোগ্যতাপত্র লাভ করলে চাকরি পাওয়া আরো সহজ। যেন থিয়েটারে নাটক দেখে পছন্দ না হলে টিকিট ফেরত দেওয়ার মতো।

ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের পরিচালক ড. এরিক পিটারসন মনে করেন, থিয়েটারসম্পর্কিত প্রভাবের মূল কারণ মানুষের ভয় ও সাহসের অভাবের সাথে জড়িত। গ্রুপ পর্যটন ও সামাজিক অনুশীলন বাচ্চাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্প্রসারণ করতে সক্ষম। তাদের চিন্তার পদ্ধতি সম্প্রসারিত হলে ভিন্ন পথ বাছাই করতে এবং জীবনযাপনের ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

শিক্ষা গ্রহণের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ভুল ঘটনা জানার পর সাহসের সাথে ভুল আচরণ প্রত্যাখ্যান করা। এ সম্পর্কে ড. পিটারসন মনে করেন, মানুষের ভয়ের মূল কারণ অজ্ঞতা। বাস্তবতা খুঁজে বের করার পর ভয়ও নির্মূল করা সম্ভব।

চীনের হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ছেং চিয়ে মিং বলেন, থিয়েটারের প্রভাবসম্পর্কিত ঘটনার মূল কারণ মূল্যবোধের অভাব। জীবনে সফলতা অর্জন করতে পারবে কিনা বা প্রতিযোগিতায় জয়ী হবে কিনা এমন বিষয় শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাণচঞ্চলতা নেই।

তিনি বলেন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা একাডেমির অধ্যাপক ক্লায়েন্ট ক্রিস্টেনসেন 'কিভাবে তোমার জীবনযাপন পর্যালোচনা করো' নামে একটি বই রচনা করেছেন। বইটিতে বলা হয়েছে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা একাডেমির স্নাতকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি লাভের পর প্রত্যেক ৫ বছরে একবার মিলিত হয়। প্রথম ৫ বছরে সবাই জীবনের বহুমুখী গতি, দ্বিতীয় ৫ বছরে বিবাহ, বাচ্চা জন্মগ্রহণ, পদোন্নতি ও তৃতীয় ৫ বছরে ব্যস্ততার কারণে উপস্থিত হতে পারে না। চতুর্থ ৫ বছরে কেউ কেউ ব্যবসায় ব্যর্থ হওয়া, বিবাহবিচ্ছেদ ইত্যাদি কারণে উপস্থিত হতে পারে না এবং পঞ্চম ৫ বছরে কেউ কেউ হয়তো বিভিন্ন অপরাধের কারণে জেলখানায় বন্দী থাকার কারণে অনুপস্থিত থাকে। যারা বিশ্বের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী ছিলেন, তারা হার্ভার্ডে লেখাপড়ার সময় এমন ফলাফলের কথা কখনো ভাবে নি।

বর্তমান ও ভবিষ্যতের সম্মুখীন শিক্ষার সঙ্গে আমাদের অতীত সমাজের অনেক পার্থক্য রয়েছে। অতীতে পেশাগত প্রযুক্তি বা দক্ষতা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি লাভ করে সবাই খুব সম্ভবত সারা জীবন একটি কোম্পানিতে চাকরি করতো। তবে ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর খুব সম্ভবত সবাই ভিন্ন চাকরিতে যোগ দেবে এবং নিজেই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা বা ব্যক্তিগত ব্যবসার দিকে মনোযোগ দেবে।

তাই এ উপলক্ষ্যে অনেক দেশে 'কেন্দ্রীয় যোগ্যতা ও দক্ষতা'-র চিন্তাধারা পেশ করা হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রে উত্থাপিত 'কেন্দ্রীয় যোগ্যতা ও দক্ষতা' হল লেখাপড়া, হিসাব ও নব্যতাপ্রবর্তন। স্পষ্ট বিবেচনা, যোগাযোগ, সহযোগিতা, তথ্য, মিডিয়া ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি অর্জনকারী দক্ষতা ইত্যাদি। সিঙ্গাপুরে এমন দক্ষতা হল আত্মবিশ্বাস, আত্মসচেতনতা, আত্মঅবদানকারী, যোগাযোগ, সহযোগিতা ও তথ্য বিনিময় দক্ষতা, পর্যালোচনা ও নব্যতাপ্রবর্তনের চিন্তাভাবনা, আন্তঃসংস্কৃতির সচেতনতা ইত্যাদি। চীনের হংকং বিশেষ প্রশাসনিক এলাকায় উত্থাপিত এ ধরনের যোগ্যতার চারটি বিষয় রয়েছে। যেমন- লেখাপড়ার যোগ্যতা, স্ব-চাষ, সাহস ও দায়িত্বশীল চরিত্র এবং মূল্যবোধ। মূল্যবোধ না থাকলে শিক্ষাগ্রহণের কোনো মানে নেই।

এখন প্রশ্ন হলো কিভাবে ভবিষ্যতের সম্মুখীন এমন দক্ষতা অর্জন করা যাবে? হ্যাঁ, এ জন্য দরকার শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার এবং গোটা সমাজের প্রচেষ্টা ও সমর্থন।

ফোরাম শেষে উপস্থাপক ছুই ইয়োং ইউয়ান বলেন, শিক্ষার সংস্কার আমাদের বিভিন্ন বিস্তারিত পদক্ষেপের মধ্যে প্রতিফলিত হবে। এতে মানবতাসহ বাচ্চাদের চরিত্র রক্ষা করা উচিত। শিক্ষাদানের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাধারা যে-কোনো বিষয়ের চেয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ। বিস্তারিত বা ক্ষুদ্র পদক্ষেপ খুব সম্ভবত শিক্ষাকে পরিবর্তন করতে পারবে। এতে আমাদের শিক্ষাদান সুন্দর ভবিষ্যতের সম্মুখীন হবে এবং আমাদের জীবনযাপনের পরিবেশও হবে সুন্দর।'

সুপ্রিয় শ্রোতা, সময় দ্রুত চলে যায়। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানও এখানেই শেষ করতে হবে। এ অনুষ্ঠান সম্পর্কে কোনো মতামত থাকলে আমাদের চিঠি লিখতে ভুলবেন না। আমাদের যোগাযোগ ঠিকানা ben@cri.com.cn,caoyanhua@cri.com.cn

সময় মতো আমাদের অনুষ্ঠান শুনতে না পারলে বা শুনতে মিস করলে আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারবেন। আমাদের

ওয়েবসাইটের ঠিকানা: www.bengali.cri.cn

(সুবর্ণা/টুটুল)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040