রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'হৈমন্তী' গল্প (দ্বিতীয় অংশ)
  2018-01-27 18:16:06  cri


 

আমার শ্বশুরের নাম গৌরীশংকর। যে হিমালয়ে বাস করিতেন সেই হিমালয়ের তিনি যেন মিতা। তাঁহার গাম্ভীর্যের শিখরদেশে একটি স্থির হাস্য শুভ্র হইয়াছিল। আর, তাঁহার হৃদয়ের ভিতরটিতে স্নেহের যে-একটি প্রস্রবণ ছিল তাহার সন্ধান যাহারা জানিত তাহারা তাঁহাকে ছাড়িতে চাহিত না।

কর্মক্ষেত্রে ফিরিবার পূর্বে আমার শ্বশুর আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, " বাবা , আমার মেয়েটিকে আমি সতেরো বছর ধরিয়া জানি , আর তোমাকে এই ক ' টি দিন মাত্র জানিলাম , তবু তোমার হাতেই ও রহিল । যে ধন দিলাম, তাহার মূল্য যেন বুঝিতে পার , ইহার বেশি আশীর্বাদ আর নাই। "

তাঁহার বেহাই বেহান সকলেই তাঁহাকে বার বার করিয়া আশ্বাস দিয়া বলিলেন, " বেহাই , মনে কোনো চিন্তা রাখিয়ো না। তোমার মেয়েটি যেমন বাপকে ছাড়িয়া আসিয়াছে এখানে তেমনি বাপ মা উভয়কেই পাইল। "

তাহার পরে শ্বশুরমশায় মেয়ের কাছে বিদায় লইবার বেলা হাসিলেন; বলিলেন, "বুড়ি, চলিলাম। তোর একখানি মাত্র এই বাপ, আজ হইতে ইহার যদি কিছু খোওয়া যায় বা চুরি যায় বা নষ্ট হয় আমি তাহার জন্য দায়ী নই। "

মেয়ে বলিল, "তাই বৈকি । কোথাও একটু যদি লোকসান হয় তোমাকে তার ক্ষতিপূরণ করিতে হইবে। "

অবশেষে নিত্য তাঁহার যে-সব বিষয়ে বিভ্রাট ঘটে বাপকে সে সম্বন্ধে সে বার বার সতর্ক করিয়া দিল। আহারসম্বন্ধে আমার শ্বশুরের যথেষ্ট সংযম ছিল না, গুটিকয়েক অপথ্য ছিল , তাহার প্রতি তাঁহার বিশেষ আসক্তি — বাপকে সেই-সমস্ত প্রলোভন হইতে যথাসম্ভব ঠেকাইয়া রাখা মেয়ের এক কাজ ছিল। তাই আজ সে বাপের হাত ধরিয়া উদ্বেগের সহিত বলিল, " বাবা, তুমি আমার কথা রেখো — রাখবে ?"

বাবা হাসিয়া কহিলেন, "মানুষ পণ করে পণ ভাঙিয়া ফেলিয়া হাঁফ ছাড়িবার জন্য, অতএব কথা না-দেওয়াই সব চেয়ে নিরাপদ। "

তাহার পরে বাপ চলিয়া আসিলে ঘরে কপাট পড়িল। তাহার পরে কী হইল কেহ জানে না।

বাপ ও মেয়ের অশ্রুহীন বিদায়ব্যাপার পাশের ঘর হইতে কৌতূহলী অন্তঃপুরিকার দল দেখিল ও শুনিল । অবাক কাণ্ড! খোট্টার দেশে থাকিয়া খোট্টা হইয়া গেছে! মায়ামমতা একেবারে নাই!

আমার শ্বশুরের বন্ধু বনমালীবাবুই আবাদের বিবাহের ঘটকালি করিয়াছিলেন। তিনি আমাদের পরিবারেরও পরিচিত । তিনি আমার শ্বশুরকে বলিয়াছিলেন, "সংসারে তোমার তো ঐ একটি মেয়ে।এখন ইহাদেরই পাশে বাড়ি লইয়া এইখানেই জীবনটা কাটাও।"

তিনি বলিলেন, "যাহা দিলাম তাহা উজাড় করিয়াই দিলাম। এখন ফিরিয়া তাকাইতে গেলে দুঃখ পাইতে হইবে । অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার মতো এমন বিড়ম্বনা আর নাই।"

সব-শেষে আমাকে নিভৃতে লইয়া গিয়া অপরাধীর মতো সসংকোচে বলিলেন, "আমার মেয়েটির বই পড়িবার শখ , এবং লোকজনকে খাওয়াইতে ও বড়ো ভালোবাসে । এজন্য বেহাইকে বিরক্ত করিতে ইচ্ছা করি না। আমি মাঝে মাঝে তোমাকে টাকা পাঠাইব । তোমার বাবা জানিতে পারিলে কি রাগ করিবেন।"

প্রশ্ন শুনিয়া কিছু আশ্চর্য হইলাম । সংসারে কোনো-একটা দিক হইতে অর্থসমাগম হইলে বাবা রাগ করিবেন , তাঁহার মেজাজ এত খারাপ তো দেখি নাই।

যেন ঘুষ দিতেছেন, এমনিভাবে আমার হাতে একখানা একশো টাকার নোট গুঁজিয়া দিয়াই আমার শ্বশুর দ্রুত প্রস্থান করিলেন; আমার প্রণাম লইবার জন্য সবুর করিলেন না। পিছন হইতে দেখিতে পাইলাম , এইবার পকেট হইতে রুমাল বাহির হইল ।

আমি স্তব্ধ হইয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম । মনে বুঝিলাম, ইহারা অন্য জাতের মানুষ।

বন্ধুদের অনেককেই তো বিবাহ করিতে দেখিলাম। মন্ত্র পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্ত্রীটিকে একেবারে এক গ্রাসে গলাধঃকরণ করা হয় । পাকযন্ত্রে পৌঁছিয়া কিছুক্ষণ বাদে এই পদার্থটির নানা গুণাগুণ প্রকাশ হইতে পারে এবং ক্ষণে ক্ষণে আভ্যন্তরিক উদ্বেগ উপস্থিত হইয়াও থাকে, কিন্তু রাস্তাটুকুতে কোথাও কিছুমাত্র বাধে না। আমি কিন্তু বিবাহসভাতেই বুঝিয়াছিলাম, দানের মন্ত্রে স্ত্রীকে যেটুকু পাওয়া যায় তাহাতে সংসার চলে, কিন্তু পনেরো-আনা বাকি থাকিয়া যায়। আমার সন্দেহ হয় , অধিকাংশ লোকে স্ত্রীকে বিবাহমাত্র করে , পায় না, এবং জানেও না যে পায় নাই; তাহাদের স্ত্রীর কাছেও আমৃত্যুকাল এ খবর ধরা পড়ে না । কিন্তু , সে যে আমার সাধনার ধন ছিল; সে আমার সম্পত্তি নয়, সে আমার সম্পদ ।

শিশির — না, এ নামটা আর ব্যবহার করা চলিল না । একে তো এটা তাহার নাম নয়, তাহাতে এটা তাহার পরিচয়ও নহে । সে সূর্যের মতো ধ্রুব; সে ক্ষণজীবিনী উষার বিদায়ের অশ্রুবিন্দুটি নয় । কী হইবে গোপনে রাখিয়া। তাহার আসল নাম হৈমন্তী।

দেখিলাম, এই সতেরো বছরের মেয়েটির উপরে যৌবনের সমস্ত আলো আসিয়া পড়িয়াছে, কিন্তু এখনো কৈশোরের কোল হইতে সে জাগিয়া উঠে নাই । ঠিক যেন শৈলচূড়ার বরফের উপর সকালের আলো ঠিকরিয়া পড়িয়াছে , কিন্তু বরফ এখনো গলিল না । আমি জানি , কী অকলঙ্ক শুভ্র সে, কী নিবিড় পবিত্র ।

আমার মনে একটা ভাবনা ছিল যে , লেখাপড়া-জানা বড়ো মেয়ে , কী জানি কেমন করিয়া তাহার মন পাইতে হইবে । কিন্তু, অতি অল্পদিনেই দেখিলাম , মনের রাস্তার সঙ্গে বইয়ের দোকানের রাস্তার কোনো জায়গায় কোনো কাটাকাটি নাই । কবে যে তাহার সাদা মনটির উপরে একটু রঙ ধরিল , চোখে একটু ঘোর লাগিল, কবে যে তাহার সমস্ত শরীর মন যেন উৎসুক হইয়া উঠিল, তাহা ঠিক করিয়া বলিতে পারিব না।

এ তো গেল এক দিকের কথা । আবার অন্য দিকও আছে, সেটা বিস্তারিত বলিবার সময় আসিয়াছে।

রাজসংসারে আমার শ্বশুরের চাকরি। ব্যাঙ্কে যে তাঁহার কত টাকা জমিল সে সম্বন্ধে জনশ্রুতি নানাপ্রকার অঙ্কপাত করিয়াছে, কিন্তু কোনো অঙ্কটাই লাখের নীচে নামে নাই । ইহার ফল হইয়াছিল এই যে, তাহার পিতার দর যেমন-যেমন বাড়িল হৈমর আদরও তেমনি বাড়িতে থাকিল । আমাদের ঘরের কাজকর্ম রীতিপদ্ধতি শিখিয়া লইবার জন্য সে ব্যগ্র, কিন্তু মা তাহাকে অত্যন্ত স্নেহে কিছুতেই হাত দিতে দিলেন না । এমন-কি, হৈমর সঙ্গে পাহাড় হইতে যে দাসী আসিয়াছিল যদিও তাহাকে নিজেদের ঘরে ঢুকিতে দিতেন না তবু তাহার জাত সম্বন্ধে প্রশ্নমাত্র করিলেন না, পাছে বিশ্রী একটা উত্তর শুনিতে হয় ।

এমনিভাবেই দিন চলিয়া যাইতে পরিত, কিন্তু হঠাৎ একদিন বাবার মুখ ঘোর অন্ধকার দেখা গেল । ব্যাপারখানা এই — আমার বিবাহে আমার শ্বশুর পনেরো হাজার টাকা নগদ এবং পাঁচ হাজার টাকার গহনা দিয়াছিলেন । বাবা তাঁহার এক দালাল বন্ধুর কাছে খবর পাইয়াছেন , ইহার মধ্যে পনেরো হাজার টাকাই ধার করিয়া সংগ্রহ করিতে হইয়াছে, তাহার সুদও নিতান্ত সামান্য নহে । লাখ টাকার গুজব তো একেবারেই ফাঁকি ।

যদিও আমার শ্বশুরের সম্পত্তির পরিমাণ সম্বন্ধে আমার বাবার সঙ্গে তাঁহার কোনোদিন কোনো আলোচনাই হয় নাই , তবু বাবা জানি না, কোন্ যুক্তিতে ঠিক করিলেন , তাঁহার বেহাই তাঁহাকে ইচ্ছাপূর্বক প্রবঞ্চনা করিয়াছেন। (বাকী অংশ আগামী সপ্তাহে)

প্রিয় শ্রোতা, এ অনুষ্ঠান সম্পর্কে কোনো মতামত থাকলে আমাদের কাছে চিঠি লিখবেন। আমাদের যোগাযোগ ঠিকানা: ben@cri.com.cn,enamulhoquetutul@yahoo.com

রেডিও'র মাধ্যমে আমাদের অনুষ্ঠান শুনতে না পারলে বা শুনতে মিস করলে বাংলা বিভাগের ওয়েবসাইটে শুনতে পারবেন। আমাদের ওয়েবসাইটের ঠিকানা www.bengali.cri.cn

আজ তাহলে এখানেই বিদায় বন্ধুরা। আগামী সপ্তাহে আবারও কথা হবে। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন; থাকুন সুন্দর ও আনন্দে। চাই চিয়ান। (টুটুল)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040