কফিহাউসের আড্ডা: আমাদের প্রিয় খাবার ও তার স্মৃতি
  2018-10-05 14:15:52  cri


জীবন চলার পথে 'কত স্বপ্নের রোদ ওঠে, আর কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়! কতজন এলো-গেলো কতজনই আসবে- কফিহাউসটা শুধু থেকে যায়।' প্রিয় বন্ধুরা, কফিহাউসও থাকবে আর এই ২০ মিনিট আমি আছি আপনাদের সঙ্গে। শেয়ার করবো জীবনের অনেক কথা।

সুপ্রিয় শ্রোতা আমি ইয়াং ওয়েই মিং স্বর্ণা। সাপ্তাহিক 'কফিহাউসের আড্ডা' অনুষ্ঠানে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। এ সপ্তাহে আড্ডার বিষয় হচ্ছে: আমাদের প্রিয় খাবার ও তার স্মৃতি। আজকের আড্ডায় আমার সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন অর্পিতা ঐশ্বর্য। তিনি বাংলাদেশে বেশ কিছুদিন সামাজিক উন্নয়ন খাতের প্রশিক্ষণ ও নীতি গবেষণায় কাজ করার পর পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণনীতিমালা (পাবলিক পলিসি)-তে স্নাতকোত্তর করেছেন। বর্তমান তিনি শিক্ষকতা ও গবেষণায় জড়িত রয়েছেন।

১. চীনের খাওয়া-দাওয়ার রীতি

চীনে একটি প্রবাদ আছে, ওষুধ সেবনের চেয়ে পুষ্টিকর খাবার খাওয়াই ভালো। এর অর্থ, নিজেকে আরো স্বাস্থ্যবান করার জন্য দৈনন্দিন খাবার ও খাওয়ার অভ্যাস আরো উপযুক্ত করা দরকার। যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো, তারা নিজেদের খাওয়া-দাওয়া ক্ষেত্রে অধিকতর মনোযোগ দেন। চীনে সামাজিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে খাওয়া দাওয়ার বিশেষ রীতি আছে। যেমন উত্সবের খাবার, বিয়ে অনুষ্ঠান ও শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের খাবার, বিভিন্ন ধর্মীয় উত্সবের খাবার, জন্মবার্ষিকীর খাবার ও নতুন সন্তান জন্মের পর বিশেষ খাবার ইত্যাদি।

 আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে আদান-প্রদানের সময় লোকেরা পরস্পর উপহার বিনিময় করেন। যেমন আত্মীয়ের সন্তান হলে বা বাড়ি বদল হলে, তাদের বাড়িতে যাওয়ার সময় সাধারণত কিছু উপহার নেওয়া হয়। অতিথিদের স্বাগত জানানোর জন্য স্বাগতিকরা ভালো ভালো খাবার দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করেন। ব্যবসা করার সময়ও ব্যবসায়ীরা সাধারণত রেস্তোরাঁয় খেতে খেতে আলাপ করেন। খাওয়া শেষ হলে ব্যবসার আলাপও শেষ হয়ে যায়।

খাওয়ার ব্যাপারে চীনের বিভিন্ন জায়গার রীতিনীতিও আলাদা। বেইজিংয়ে প্রাচীনকালে অতিথিদের নুডুলস খাওয়ানো হতো। যদি মেহমান স্বাগতিকদের বাসায় থাকেন, তাহলে তাকে স্বাগত জানানোর জন্য 'চিয়াও য্যি' নামে এক ধরনের মাংসের পুর দেয়া পিঠা খাওয়ানো হয়। বন্ধু বা আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গেলে আট ধরনের কেক-জাতীয় খাবার উপহার হিসেবে দিতে হয়। দক্ষিণ চীনের পল্লী অঞ্চলে অতিথি আসলে চায়ের কাপ দেয়ার পর অতিথিদের দু-তিনটা ডিমের সুপ বা অন্যান্য নাস্তা দেওয়ার রীতি আছে। নাস্তার পর দুপুর বা সন্ধ্যাবেলার খাবার তৈরি করা হয়।

দক্ষিণ-পূর্ব চীনের ফুচিয়েন প্রদেশের ছিউয়ান চৌ শহরে স্থানীয় অধিবাসীরা অতিথিদের ফল খাওয়ান। তারা এই ফলকে 'থিয়েন থিয়েন' বলেন, তার অর্থ- মিষ্টি। ফলগুলোর মধ্যে কমলা থাকে, কারণ স্থানীয় ভাষায় কমলালেবুর উচ্চারণ 'চি' বা কল্যাণ উচ্চারণের মতো। কাজেই তারা মেহমানদের কমলালেবু পরিবেশনের মাধ্যমে তাদের কল্যাণ ও তাদের জীবন কমলালেবুর মতো মিষ্টি হবে- এমনটা কামনা করেন।

মেহমানদের আপ্যায়ন করার সময় তরি-তরকারির সংখ্যার মধ্যেও পার্থক্য থাকে। বেইজিং শহরে সাধারণত কমপক্ষে দুটি ঠান্ডা আর আটটি গরম তরকারি থাকে। উত্তর-পূর্ব চীনের হেইলোংচিয়াং প্রদেশে একই তরকারির দুটি প্লেট থাকতে হয়। কোনো কোনো অঞ্চলে তরকারির মধ্যে মাছ থাকতে হয়। এর অর্থ হলো জীবনে কোনো অভাব না থাকা। নাগরিকদের জীবনে বিয়ে সম্পর্কিত ভোজ অনুষ্ঠান সবচেয়ে বেশি। যেমন বিয়ের প্রস্তাবের ভোজ, বর-কনে দেখা-সাক্ষাতের ভোজ, বাগদান ভোজ, বিয়ে অনুষ্ঠানের ভোজ আর বিয়ের পর কনের বাপ-মার বাড়ি প্রত্যাবর্তনের ভোজ ইত্যাদি। এসব ভোজানুষ্ঠানের মধ্যে বিয়ে অনুষ্ঠানের ভোজ সবচেয়ে আড়ম্বরপূর্ণ। যেমন পশ্চিম চীনের শানসি প্রদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে বিয়ে অনুষ্ঠানের প্রতিটি তরকারির নাম আছে। যেমন প্রথম তরকারির নাম হলো 'লাল মাংস' , চীনে লাল রংয়ের অর্থ হলো আনন্দ, এই তরকারির অর্থ হলো গোটা পরিবার আনন্দে ভরপুর। দ্বিতীয় তরকারির নাম হলো 'ছিউয়ান চিয়া ফু', এর অর্থ হলো গোটা পরিবারই মহাসম্মেলন ও সুখ-শান্তিতে থাকা। তৃতীয় পরিবেশন হলো এক ধরনের মিষ্টি। এই মিষ্টি আঠালো-চাউল, কুল, শুকনা ফল, পদ্মফুলের বীজ প্রভৃতি আট ধরনের খাবার দিয়ে তৈরি করা হয়, এর অর্থ হলো স্বামী-স্ত্রী পক্বকেশ পর্যন্ত সুখী জীবনযাপন করবেন। পূর্ব চীনের চিয়াং সু প্রদেশের পল্লী অঞ্চলে বিয়ে অনুষ্ঠানে ১৬টি তরকারি, ২৪টি তরকারি অথবা ৩৬টি তরকারি পরিবেশনের রীতি চালু আছে। বয়োবৃদ্ধদের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত ভোজানুষ্ঠানে দীর্ঘ নুডুলস রাখতে হবে। পূর্ব চীনের হাংচৌ শহর আর উত্তর চিয়াংসু অঞ্চলে বৃদ্ধদের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দুপুর বেলায় দীর্ঘকায় নুডুলস খাওয়া হয় আর সন্ধ্যায় ভোজানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। হাংচৌ শহরের অধিবাসীরা নুডুলস খাওয়ার সময় পরিবারের প্রত্যেক সদস্য নিজের বাটি থেকে দু-একটি নুডুলস বের করে বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাকে দেন। এর অর্থ হলো আয়ু বাড়ার প্রত্যাশা করা। তা ছাড়া, সেদিন নুডুলস এক বাটি খেলে হবে না, প্রত্যেককেই দুই বাটি নুডুলস খেতে হবে। অর্ধেক বাটি হলে দু'বার খেতে হবে, তা না হলে অকল্যাণ হবে বলে মনে করা হয় ।

* চীনের খাদ্যাভ্যাস

বৈচিত্র্যময় দুনিয়ায় প্রত্যেকটি জাতির ঐতিহ্যগত অভ্যাসে ভিন্নতা লক্ষণীয়। বিশেষ করে চীনা জাতির সাথে অন্যান্য জাতির এই পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান। যেমন, খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে চীনাদের অভ্যাসের কিছু নমুনা:

(১) সকালের নাস্তা খুব ভোরে খাওয়া। চীনে পাড়া-মহল্লায় খাবারের দোকানগুলো ভোর সাড়ে ৫টায় চালু হয়ে যায়। হকাররাও রকমারি নাস্তা নিয়ে রাস্তায় বসে পড়ে। চীনাদের সকালের নাস্তার মধ্যে 'হুনতুন' এবং 'চৌ' সবচেয়ে প্রিয়। চৌ বাংলাদেশের জাউ-এর মতো। তবে চৌ জাউ এর তুলনায় অনেক পাতলা। এছাড়াও আছে মানথৌ, পাওয্যি। মানথৌ অনেকটা মুঠো পিঠার মতো, তবে অনেক নরম। আর এর ভেতরে কিছুই থাকে না।

দুপুরের খাবার সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে শেষ হয়। রাতের খাবারের ব্যাপারে চীনা মানুষ মনে করে, তাড়াতাড়ি খাওয়া উচিত যাতে ঘুমানোর আগেই খাবার হজম হয়ে যায়। তাই ৫টা থেকে সাড়ে ৬টার মধ্যেই রাতের খাবার খাওয়া শেষ হয়।

(২) চীনা মানুষ রেস্টুরেন্টে অনেক সময় নিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে গল্প করে না বরং গল্পের ফাঁকে ফাঁকে খায়। আর একটা ব্যাপার বেশ লক্ষণীয়, তা হচ্ছে ভালো রেস্টুরেন্ট এমনকি পাড়া-মহল্লার ছোট ছোট হোটেলেও খাবার আগে থেকে রান্না করা থাকে না। গ্রাহক অর্ডার দেওয়ার পর রান্না শুরু হয়। কারণ চীনারা গরম গরম খাবার খেতে পছন্দ করে। চীনারা সবকিছু তরতাজা চায়। বিশেষ করে এখানে তাজা মাছ বিক্রি হয়। রাস্তার দোকানদাররাও মাছ বড় ড্রামের পানির মধ্যে রাখে। কারণ, তাজা মাছের দাম মরা মাছের তুলনায় দ্বিগুণ। চীনারা রেস্টুরেন্টে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা সময় নিয়ে খায়, অর্থাৎ গল্প এবং খাওয়া চলে একসঙ্গে। বন্ধুরা সবাই মিলে একসাথে গল্প করা মানেই- সেটা হবে খাওয়ার টেবিলে। চীনে ভারি খাবার-দাবার ছাড়া কোনো পার্টির কথা চিন্তাও করা যায় না। এদিক থেকে চীন এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে বেশ মিল আছে।

(৩) উত্তর চীন ও দক্ষিণ চীনের মানুষের মধ্যে খাওয়া-দাওয়াসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত ক্ষেত্রে ভিন্নতা লক্ষ করা যায়।

* খাবার নয়, কার সঙ্গে খাওয়া হচ্ছে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ

আমাদের খাবার নিয়ে যে স্মৃতিগুলো স্মরণীয়, সেগুলো কিন্তু শুধু খাবারকে কেন্দ্র করে নয়, বরং কার সঙ্গে, কোন পরিবেশে খাওয়া হচ্ছে, তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

চীনা মানুষ শুধু রকমারির খাবারের ওপরই গুরুত্ব দেয় না, বরং সামাজিক বিনিময় জোরদারের একটি প্রধান মাধ্যম হিসেবে এই খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেয়। কারণ খাবারের সঙ্গে গল্প-গুজব করা বা আড্ডা দেওয়া আসল বিষয়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তই নেওয়া হয় খাবার টেবিলে।

(স্বর্ণা/তৌহিদ)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040