চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধে আপাতত বিরতি; বিশ্লেষকদের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া (অর্থ-কড়ি; ৮ ডিসেম্বর ২০১৮)
  2018-12-08 13:26:43  cri


১. চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্‌স আয়ার্সে বৈঠক করেন এবং দু'দেশের সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিতে একমত হন। বৈঠকে দু'নেতা আর্থ-বাণিজ্য সমস্যা সমাধানে ঐকমত্যে পৌঁছান এবং একে অপরের রফতানিপণ্যের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেন।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, দু'দেশের নেতৃবৃন্দ এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কার্যত বাণিজ্যযুদ্ধ এড়ানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। এটা সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে দু'দেশের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। দু'দেশের মধ্যে পরবর্তী আলোচনার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা আশাবাদ প্রকাশ করেছেন।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদ্বয়ের যৌথ সিদ্ধান্ত অনুসারে, অভ্যন্তরীণ বাজার ও জনগণের চাহিদা অনুযায়ী চীন আমদানি বাড়াবে। বিশেষ করে, চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উপযোগী পণ্য আমদানি বাড়াবে, যা দু'দেশের মধ্যে বাণিজ্য-ঘাটতি কমাতে সাহায্য করবে। তা ছাড়া, দু'দেশ পরস্পরের জন্য বাজারকে আরও উন্মুক্ত করবে এবং চীনের নতুন দফা সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তিযুক্ত দাবি গ্রাহ্য করা হবে।

আরও সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, দু'দেশের কর্মগ্রুপ দুই প্রেসিডেন্টের মতৈক্য অনুযায়ী আলোচনা করবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পারস্পরিক কল্যাণকর একটি বাণিজ্যচুক্তি স্বাক্ষর করবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষিজাত পণ্যসহ অনেক মার্কিন পণ্যের জন্য চীনের বাজার খুব গুরুত্বপূর্ণ। দু'দেশের শীর্ষ নেতারা ঐকমত্যে পৌঁছে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। তাদের মতে, সি-ট্রাম্প শীর্ষবৈঠক দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় দিক্‌নির্দেশনা দিতেও সক্ষম হয়েছে।

২. চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক অর্থনীতি বিভাগের পরিচালক ওয়াং শিয়াও লুং সম্প্রতি বেইজিংয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এবং বাণিজ্যে সংরক্ষণবাদ ও একতরফাবাদের হুমকির প্রেক্ষাপটে, এবার আর্জেন্টিনায় জি-টোয়েন্টি শীর্ষসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আর সম্মেলনশেষে গৃহীত 'বুয়েন্স আয়ার্স ঘোষণা'য় আন্তর্জাতিক সমাজের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে। চীন একে অভিনন্দন জানায়।

ওয়াং শিয়াও লুং বলেন, জি-টোয়েন্টি শীর্ষসম্মেলন এ পর্যন্ত ১০ বার আয়োজিত হয়েছে। এর মধ্যে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ৬টি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। চীনা প্রেসিডেন্ট মনে করেন, উন্মুক্তকরণ ও সহযোগিতার ভিত্তিতে বহুপক্ষবাদ ব্যবস্থা রক্ষা করা, সামষ্টিক নীতিগত সমন্বয় জোরদার করা, নবত্যপ্রবর্তনের মাধ্যমে অর্থনীতি বৃদ্ধির নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করা, এবং বিশ্বের সহনশীল উন্নয়ন বাস্তবায়ন করা জরুরি। আর এসবের পূর্বশর্ত হচ্ছে, উন্নয়নের বিদ্যমান প্রবণতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ও অর্থনীতির উন্নয়নের নিয়ম অনুসরণ করে, সঠিক পথে সামনে এগিয়ে যাওয়া।

ওয়াং শিয়াও লুং আরও বলেন, শীর্ষসম্মেলনে বহুপক্ষীয় বাণিজ্যব্যবস্থা রক্ষা এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সংস্কারে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে ঐকমত্য সৃষ্টিতে চীনের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি, চীন বৈশ্বিক প্রশাসনসংশ্লিষ্ট একটি সম্পূর্ণ প্রস্তাব দিয়েছে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দৃঢ় সংকল্প ঘোষণা করেছে।

৩. নেপাল ও চীন চলমান দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পসমূহ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার ব্যাপারে একমত হয়েছে। সম্প্রতি কাঠমান্ডুতে দু'দেশের কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে এ ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

উল্লেখ্য, বর্তমানে চীন ও নেপাল যৌথভাবে বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করছে। এগুলোর মধ্যে আছে: পোখারা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, রিং রোডের কোতেশর-কালানকি অংশ, কাঠমান্ডুতে বাসান্তাপুর দর্বার স্কোয়ারের পুনর্গঠন, এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি স্কুলভবন।

৫. কাতার ওপেক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত আগামী বছরের পয়লা জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। কাতারভিত্তিক ইংরেজি দৈনিক গাল্ফ টাইমস্‌ এ খবর দিয়েছে।

কাতারের জ্বালানিমন্ত্রী সাদ বিন শেরিদা আল-কাবি বলেছেন, এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে তাঁর দেশের বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবরোধের কোনো সম্পর্ক নেই।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের জুন থেকে সৌদি আরবের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি আরব দেশ কাতারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে রেখেছে।

৬. যৌথভাবে পাঁচটি অর্থনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সৌদি আরব ও আলজেরিয়া। সম্প্রতি সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মাদ বিন সালমানের আলজিয়ার্স সফরকালে দু'দেশের মধ্যে এ ব্যাপারে সমঝোতা হয়। প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নকাজ ২০১৯ সালে শুরু হবে।

প্রকল্পগুলোর মধ্যে আছে এক কোটি ডলার মূল্যের ফার্মাসিউটিকেল ইন্ডাস্ট্রি, দুই কোটি ডলার মূল্যের স্বাস্থ্যকর কাগজ উত্পাদন কারখানা ইত্যাদি।

৭. বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বিরাজমান বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে জি-টোয়েন্টির সদস্যরাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টিন লাগার্দে। সম্প্রতি আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ার্সে জি-টোয়েন্টি শীর্ষসম্মেলনশেষে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে তিনি এ আহ্বান জানান।

বিবৃতিতে লাগার্দে বলেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় ধীর গতি ও ভারসাম্যহীনতা দৃশ্যমান। তা ছাড়া, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে টানাপড়েন নতুন উদীয়মান অর্থনৈতিক সত্ত্বাগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ও চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এসব কারণে ঝুঁকিও বাড়ছে। এ অবস্থায় পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ও সঠিক নীতি প্রণয়ন করা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিবৃতিতে লাগার্দে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সংঘাত নিয়ন্ত্রণ করা, রফতানিপণ্যের ওপর আরোপিত অতিরিক্তি শুল্ক তুলে নেওয়া, এবং প্রচলিত নিয়মের ভিত্তিতে বহুপক্ষীয় বাণিজ্য-ব্যবস্থা উন্নয়ন করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

৮. ২০১২ সালের পর বর্তমানে বিশ্বব্যাপী রফতানি-আদেশ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হ্রাস পেয়েছে বন্দরের ব্যবহার। তা ছাড়া, কৃষিপণ্যের বাণিজ্য, প্রযুক্তিসহ মোটরগাড়ির বাণিজ্যও কমে গেছে। আর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রায় সব সূচক নিম্নগামী হওয়ায় বিশ্ব বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি ধীর হওয়ার আশঙ্কা করেছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)।

সম্প্রতি প্রকাশিত 'ওয়ার্ল্ড ট্রেড আউটলুক ট্রেন্ড' শীর্ষক প্রতিবেদনে চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-আগস্ট) বিশ্ববাণিজ্যের গতিধারা বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, বাণিজ্যের প্রায় সবক'টি সূচকে অবনতি হয়েছে। বছরের শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) বাণিজ্যের গতি আরও কমে আসবে। গেল সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত পূর্বাভাস প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, চলতি বছর (২০১৮) শেষ নাগাদ বিশ্ববাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি ৩.৯ শতাংশে নেমে আসবে, যা আগামী বছর (২০১৯) আরও কমে ৩.৭ শতাংশ হতে পারে।

এদিকে, বাংলাদেশের রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)-র হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুসারে, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রফতানি বেড়েছে ১২.৫৭ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে ১২১৩ কোটি মার্কিন ডলারের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রফতানি হয়েছে ১৩৬৫ কোটি ডলার মুল্যের পণ্য।

৯. বাংলাদেশে করদাতার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। সম্প্রতি এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, ২০১৪ সালে দেশে করদাতার সংখ্যা ছিল ১২ লাখ। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ লাখে। এর মানে, চার বছরে এই সংখ্যা বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। এনবিআর-এর লক্ষ্য করদাতার সংখ্যা এক কোটিতে উন্নীত করা। কর্মকর্তারা আরও জানান, প্রকৃত কর আদায় ১০ বছরে পাঁচ গুণ বেড়েছে।

১০. ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বাংলাদেশ থেকে চার কোটি ৩৬ লাখ ডলারের সিরামিক পণ্য রফতানি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে পণ্যটি রফতানি হয়েছিল এক কোটি ৩৫ লাখ ডলারের। সম্প্রতি রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)-র সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

উল্লেখ্য, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের পুরো সময়ে পাঁচ কোটি ১৯ লাখ মার্কিন ডলারের সিরামিক পণ্য রফতানি হয়েছিল। আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালিসহ বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশে বাংলাদেশের সিরামিক পণ্যসামগ্রী রফতানি হয়।

১১. চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বাংলাদেশি প্রবাসীরা ৬২৯ কোটি মার্কিন ডলারের রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছেন। এই অংক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি। তবে চলতি বছরের নভেম্বর মাসে গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে ৩ শতাংশ রেমিটেন্স কম পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আর অক্টোবরের চেয়ে নভেম্বরে রেমিটেন্স কমেছে ৫.১৬ শতাংশ। রেমিটেন্সের এই ধীরগতির কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভও কমেছে। গত রোববার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩০৯৯ কোটি মার্কিন ডলার।

১২. জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে পেছানো হয়েছে ২৪তম ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা-২০১৯। পয়লা জানুয়ারির পরিবর্তে ৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হবে এ মেলা; চলবে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এবারের মেলায় নারীদের জন্য সংরক্ষিত স্টল ২০টি, প্রিমিয়ার প্যাভিলিয়ন ৬০টি, প্রিমিয়ার মিনি প্যাভিলিয়ন ৩৮টি, সাধারণ প্যাভিলিয়ন ১৮টি, সাধারণ মিনি প্যাভিলিয়ন ২৯টি, প্রিমিয়ার স্টল ৬৭টি, রেস্টুরেন্ট ৩টি, সংরক্ষিত প্যাভিলিয়ন ৯টি, সংরক্ষিত মিনি প্যাভিলিয়ন ৬টি ও ২৬টি বিদেশি প্যাভিলিয়ন থাকছে।

(আলিমুল হক)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040