রোববারের আলাপন-181230
  2018-12-30 19:47:23  cri


আকাশ: সুপ্রিয় শ্রোতা, সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা অনুষ্ঠানে। আপনাদের আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু করছি আমাদের সাপ্তাহিক আয়োজন 'রোববারের আলাপন'। আপনাদের সঙ্গে আছি এনামুল হক টুটুল এবং শিয়েনান আকাশ।

বন্ধুরা, আজকের অনুষ্ঠানের শুরুতে আমরা ভারতের গ্রামের কিছু গল্প আপনাদের সাথে শেয়ার করবো, কেমন?

টুটুল: বন্ধুরা এখন আমরা চেতনা স্নেহা নামে একজন ভারতীয় ম্যাডামের কাছ থেকে এ গ্রাম সম্পর্কিত গল্প শুনবো, কেমন? ম্যাডাম চেতনা স্নেহা বলেন,

"আমি এখানে শুধু আমার গল্প আপনাদের সাথে শেয়ার করবো না, পাশাপাশি ভারতের কয়েকজন ব্যতিক্রমী নারীর গল্প আপনাদের সাথে শেয়ার করবো। আমার জীবনের পথে তাঁদের গল্প সবসময় আমাকে উতসাহিত করে, অনেক কিছু শেখায় এবং দিকনির্দেশনা দেয়। তাঁরা অবিশ্বাস্য নারী, তাঁরা কখনোই স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া করার সুযোগ পান নি। তাঁদের কোনো ডিগ্রিও নেই, তাঁরা অনেক সাধারণ বটে, কিন্তু তাঁরা অসাধারণ জিনিস করেছেন। তাঁদের সাহস, জ্ঞান ও নম্রতা আছে। তাঁরা আমার শিক্ষক। বিগত ৩০ বছর ধরে আমি ভারতে বসবাস করছি, ভারতের গ্রামের নারীদের সাথে কাজ করছি। আমার জন্ম মুম্বাইয়ে এবং আমি সেখানেই বড় হয়েছি। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন জয়প্রকাশ নারায়ণের সাথে সাক্ষাত্ হয়। তিনি একজন মহা গান্ধীবাদী নেতা। তিনি তরুণতরুণীদের গ্রামে কাজ করতে উত্সাহিত করেন। গ্রামে কাজ করার জন্য আমি গ্রামে গিয়েছি, ভূমি অধিকার আন্দোলনে আমি অংশগ্রহণ করেছি, কৃষক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি এবং নারী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি। এরকম কাজ করতে করতে আমি অবশেষে একটি ছোট গ্রামে যাই, সেখানে একজন তরুণ, সুদর্শন, কৃষক নেতার প্রেমে পড়ি। তিনি বেশি শিক্ষিত না, কিন্তু অসাধারণ মানুষ। আমি তাঁকে বিয়ে করি। এরপর আমি মুম্বাই ত্যাগ করি এবং একটি ছোটগ্রামে বসবাস শুরু করি। ওখানে কোনো টয়লেট নেই, প্রবাহমান পানিও নেই।

সত্যি বলতে আমার পরিবার ও বন্ধুরা ভীষণ ভীত ছিলো। আমি আমার পরিবারের সাথে থাকি, আমি এবং তিনজন সন্তান গ্রামে থাকি। কয়েক বছর পর একদিন, কান্তাবাই নামে একজন নারী আমার কাছে আসেন, তিনি বলেন, আমি একটি সেভিং অ্যাকাউন্ট খুলতে চাই। আমি কিছু অর্থ সেভ করতে চাই। আমি তাঁকে বলি, আপনি কর্ম-কারের কাজ করেন, আপনার কাছে কি সেভ করার মতো যথেষ্ট অর্থ আছে? আপনি এখন রাস্তায় বাস করেন, আপনার কাছে সেভ করার মতো যথেষ্ট অর্থ আছে? তিনি খুব জিদি, তিনি বলেন, বৃষ্টির মৌসুম আসার আগে আমি একটি প্লাস্টিক শিট কিনতে চাই, বৃষ্টি থেকে আমার পরিবারকে রক্ষার জন্য। এজন্য আমি তাঁর সাথে ব্যাংকে যাই। তিনি প্রতিদিন ১০ রুপি সেভ করতে চান, কিন্তু ব্যাকের ম্যানেজার তার অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যাপারটি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, আপনার সেভিং করার অর্থের পরিমাণ অনেক কম, অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন না।

কান্তাবাই ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ চাননি, অথবা তিনি সরকারের কাছ থেকে কোনো ধরনের ভর্তুকি বা অনুদানও দাবি করেন নি। তিনি শুধুমাত্র একটি নিরাপদ জায়গা চান, যাতে তিনি তাঁর কষ্টার্জিত অর্থ সেভ করতে পারেন। এটা তাঁর অধিকার। এজন্য আমি বলি, যদি ব্যাংক কান্তাবাই'র জন্য অ্যাকাউন্ট না খোলে, তাহলে আমি কেন একটা ব্যাংক খুলবো না। এতে কান্তাবাই'র মতো গ্রামের নারীরা অর্থ সেভ করতে পারবেন। এজন্য আমি ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করি। কিন্তু এটা সহজ কাজ নয়। আমাদের লাইসেন্সের আবেদন বাতিল করা হয়। কারণ ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক আমাদের জানায় যে, যে সব ক্লায়েন্টস লেখাপড়া জানেনা তাদেরকে আমরা ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদান করতে পারছি না। আমি তখন কাঁদছিলাম। বাসায় ফিরে আমি অব্যাহতভাবে কাঁদতে থাকি। আমি কান্তাবাই এবং অন্য নারীদের জানাই যে, আমরা লাইসেন্স পাবোনা। কারণ আমাদের নারীরা লেখাপড়া জানেনা। কিন্তু আমাদের নারীরা বলেন, কান্না বন্ধ করুন। আমরা এখন থেকে লেখাপড়া শিখতে শুরু করবো। তারপর আবার আমরা আবেদন করবো, কেমন? আমরা লেখাপড়ার ক্লাস শুরু করি, প্রতিদিন আমাদের নারীরা এসে লেখাপড়া করেন।

তারা খুবই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তারা সারাদিন পরিশ্রমের পর ক্লাসে এসে লেখাপড়া করেন। পাঁচ মাস পর, আমরা পুনরায় আবেদন করি। এবার আমি একা যাইনি, পনেরজন নারী আমার সঙ্গে একসাথে ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকে যান।

আমাদের নারীরা ব্যাংকের কর্মকর্তাকে বলেন, আমরা লিখতে এবং পড়তে পারতাম না বলে আপনি আমাদের ব্যাংকের আবেদনের লাইসেন্স প্রত্যাখ্যান করেছেন। আমরা যখন বড় হই তখন স্কুল ছিলোনা, এজন্য আমরা লেখাপড়া জানিনা, এটা আমাদের দোষ না।

আমরা পড়তে বা লিখতে পারি না, কিন্তু আমরা গণনা করতে পারি। আমাদের নারীরা ব্যাংকের কর্মকর্তাকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন, তাহলে আমাদের কোনো মূলধনের সুদের হিসাব করতে বলুন। যদি আমরা করতে না পারি, তাহলে আমাদের লাইসেন্স দেবেন না। ক্যালকুলেটর ছাড়াই আপনার কর্মকর্তাদের এটা করতে বলুন এবং দেখুন দ্রুত কে গণনা করতে পারে। এবার বলা বাহুল্য যে, আমরা ব্যাংকের লাইসেন্স পেয়েছি। এখন আমাদের ব্যাংকে লক্ষাধিক নারী ক্লায়েন্টস আছে। আমাদের ব্যাংকে দু'কোটিরও বেশি মার্কিন ডলারের পুঁজি আছে। এটা সব নারীদের সেভিংস। আমি আরো বলতে চাই যে, আমাদের লাইসেন্স পাওয়ার পর, এখন কান্তাবাই'র নিজের বাড়ি আছে। তার পরিবার একসাথে তাঁর নিজের বাড়িতে থাকেন। কিন্তু আমি আস্তে আস্তে আবিষ্কার করি যে, আমাদের নারী ক্লায়েন্টস ব্যাংকে আসতে পারেন না। তখন ভাবি, ঠিক আছে, তাহলে বাংক তাদের কাছে যাবে। আমরা দরজা দরজায় যাবার ব্যাংকিং সেবা শুরু করি। সম্প্রতি আমরা ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা শুরু করেছি। কিন্তু এ সেবায় পিন নাম্বার খুব জরুরি। আমাদের নারীরা বলেন, আমরা পিন নাম্বার চাইনা, এটা একটা ভালো ধারণা না। আমরা তাদের কাছে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা কলাম, আমরা বললাম, আপনাদের পিন নাম্বার মুখস্থ করা উচিত এবং আমরা আপনাদেরকে পিন নাম্বার মুখস্থ করার জন্য সহায়তা করতে পারি। তাঁরা অনেক দৃঢ়, তাঁরা আমাদের একটা প্রস্তাব দিলেন, তাঁরা বললেন আঙুলের ছাপ কেমন? বাহ, আমি ভাবছি এটা সত্যি একটা চমত্কার ধারণা। আমরা ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবাকে বায়োমেট্রিক পদ্ধতির সাথে যুক্ত করলাম। এখন তারা আঙুলের ছাপের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করতে পারেন। জানেন তাঁরা কি বলেন, তাঁরা বলেন, যে কেউ আমাদের পিন নাম্বার চুরি করতে পারে, আমাদের কষ্টার্জিত টাকা চুরি করতে পারে, কিন্তু কেউ আমার আঙুলের ছাপ চুরি করতে পারবেনা।

কয়েক মাস পর আরেকজন নারী আমাদের ব্যাংকে আসেন। তাঁর নাম কেরাবাই। তিনি তার স্বর্ণ বন্ধক রেখে ঋণ নিতে চান। আমি তাঁকে জিজ্ঞাস করলাম, কেন আপনি আপনার মূল্যবান গয়না বন্ধক রেখে ঋণ নিতে চান?

তিনি উত্তর দেন, আপনি জানেন না? খরা এখন মারাত্মক অবস্থা। পশুদের জন্য কোনো খাদ্য নেই, পানিও নেই। আমি পশুদের জন্য খাবার কেনার জন্য আমার স্বর্ণ বন্ধক রাখছি। এরপর তিনি আমাকে জিজ্ঞাস করেন, আমি কি স্বর্ণ বন্ধক রেখে পানি পেতে পারি?

আমি কোনো জবাব দিতে পারি না। তিনি আমাকে আবার বলেন, আপনি গ্রামে নারীদের সাথে আর্থিক বিষয়ে কাজ করেন। যদি পানি না থাকার কারণে আপনি গ্রাম ত্যাগ করেন, তাহলে আপনার ব্যাংকিং কাজ কিভাবে চলবে? তাঁর কথা যৌক্তিক। এজন্য এ খরায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, এ অঞ্চলে একটি গবাদি পশুর ক্যাম্প নির্মাণ করবো। কৃষকরা সেখানে তাদের পশু আনতে পারে এবং পশুদের জন্য খাবার ও পানি পেতে পারেন। বৃষ্টি হয় নি, গবাদি পশুর ক্যাম্প ১৮ মাসের জন্য বাড়ানো হয়। কেরাবাই ক্যাম্পের চারপাশে ঘুরে বেড়ায় এবং উৎসাহের গান গাইতে থাকে।

তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন, তারপর বৃষ্টি শুরু হয়। এরপর ক্যাম্প বন্ধ করা হয়। ক্যাম্প বন্ধ করার পর কেরাবাই আমাদের বেতারে আসেন। আমাদের কমিউনিটিতে বেতার আছে, আমাদের কমিউনিটিতে বেতারের লক্ষাধিক শ্রোতা আছে। তিনি বলেন, বেতারে আমি একটি স্থায়ী অনুষ্ঠান করতে চাই। আমাদের বেতারের ম্যানেজার বলেন, কেরাবাই, আপনি লিখতে বা পড়তে পারেন না, কিভাবে স্ক্রিপ্ট লিখবেন? তিনি উত্তর দেন, পড়তে এবং লিখতে আমি পারি না, কিন্তু আমি গান গাইতে পারি। এজন্য সমস্যা নেই। এখন বেতারে কেরাবাইয়ের একটি স্থায়ী অনুষ্ঠান আছে। এ ছাড়া তিনি এখন বেতারের বিখ্যাত ডি.জে হয়ে গেছেন। বিভিন্ন বেতার তাঁকে আমন্ত্রণ জানায়। মুম্বাইয়ের বেতারও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন বেতারের আমন্ত্রণে তিনি বেতারে গিয়ে অনুষ্ঠান করেন। তিনি এখন অনেক বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। একদিন আমি তাঁকে জিজ্ঞাস করি, কেন আপনি গান গাওয়া বাছাই করলেন? তিনি উত্তর দেন, সত্যি কথা বলতে কি, যখন আমি প্রথম গর্ভবতী ছিলাম, আমি সব সময় ক্ষুধার্ত থাকতাম। আমার কাছে যথেষ্ট খাবার ছিলোনা, খাবার কেনার যথেষ্ট টাকাও ছিলোনা। ক্ষুধা ভুলে থাকার জন্য আমি তখন গান গাওয়া শুরু করি।

তিনি খুব শক্তিশালী ও জ্ঞানী, তাইনা? আমি সবসময় ভাবছি আমাদের নারীরা অনেক বাধা অতিক্রম করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক সমস্যা মোকাবিলা করে তাদের পথ খুঁজে পেয়েছেন।

আকাশ: ভাই, তোমার কেমন লাগছে তাঁদের গল্প শোনার পর?

টুটুল:...

আকাশ: বন্ধুরা, চেতনা স্নেহার বলা গল্প আমরা আগামী অনুষ্ঠানে অব্যাহতভাবে আপনাদের সাথে শেয়ার করবো, কেমন? গত অনুষ্ঠানে আমরা আপনাদের সাথে পিংপং খেলোয়াড় তেং ইয়া পিংয়ের গল্প শেয়ার করেছি, সেই গল্প ছিলো অধ্যবসায় সম্পর্কে। আর আজকের গল্প মূলত সাহস সম্পর্কে। আশা করি এ দুটি গল্প নতুন বছরের উপহার হিসেবে আপনাদের ভাল লাগবে। নতুন বছরে আপনার এবং আপনার পরিবারের সবার জীবন ভরে উঠুক সুখ, সমৃদ্ধি আর শান্তিতে, এই প্রত্যাশা আমাদের।

টুটুল:…

আকাশ: ২০১৮ সালে আমরা আরো সুষ্ঠুভাবে ইতিবাচকভাবে জীবন কাটাবো এবং মনের স্বপ্ন পূরণে আরো বেশি বেশি পরিশ্রম করবো।

টুটুল: হ্যালো ২০১৯, আমরা আসছি!

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040