সংবাদ পর্যালোচনা: বাঙালির বর্ষবরণ- ইতিহাস পর্যালোচনা
  2019-04-19 11:16:23  cri

বাঙালির অন্যতম একটি উৎসব পহেলা বৈশাখ। এ উত্সবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শত বছরের কৃষ্টি-কালচার-ঐতিহ্য। শুধু শহরাঞ্চলই নয়, গ্রাম-গঞ্জ-মফস্বল থেকে শুরু করে কৃষিজীবী মানুষের নতুন বছরের কর্মসূচির সঙ্গেও এর এক ধরনের সম্পর্ক রয়েছে। বাংলা নববর্ষের ইতিহাসে স্থানীয় অনেক রীতিনীতি ও ঐতিহ্য, বাংলা ক্যালেন্ডারের জন্মলগ্ন সম্পর্কে জানা যায় । বাংলা নববর্ষ শুধু "এসো হে বৈশাখ এসো এসো, কিংবা পান্তা-ইলিশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি বাংলার ঐতিহ্যবাহী একটি সংস্কৃতিও বটে। আজকের সংবাদ পর্যালোচনায় আমরা সে সম্পর্কে কিছু কথা তুলে ধরব।

গত রোববার চির নতুনের ডাক দিয়ে আবার এলো বৈশাখ। বিগত বছরের সব অপূর্ণতা, গ্লানি, ব্যর্থতা মুছে ফেলে জীবনকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার আশায় বাঙালি উদযাপন করেছে তার একান্ত আপন নতুন বর্ষ। বাংলা নববর্ষ। বাঙালি স্বাগত জানিয়েছে নতুন বছর ১৪২৬ সনকে। এই শুভক্ষণে সবাইকে জানাই শুভেচ্ছা- 'শুভ নববর্ষ"।

কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষ চাষাবাদ, ঋতুপরিক্রমা অনুসরণ, নানা তিথি-পার্বণ, আচার অনুষ্ঠান পালনের দিনক্ষণ নির্ধারণসহ নানা বাস্তব প্রয়োজনে বাংলা বর্ষপঞ্জিই অনুসরণ করে। তবে এসব দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডকে ছাপিয়ে উৎসবের আয়োজনে বাঙালির নিজস্ব বর্ষ বিশেষ অগ্রাধিকার পেয়েছে। পহেলা বৈশাখ পরিণত হয়েছে অন্যতম উৎসবে।

যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ৫৭ বছর আগে ভারতবর্ষের সম্রাট বিক্রমাদিত্য প্রবর্তন করেন বিক্রম সাম্বাত পঞ্জিকা। তিনি হিন্দু রাজা ছিলেন, হিন্দু রাষ্ট্র নেপাল এই পঞ্জিকা মেনে চলে। বিক্রম সাম্বাতের সেই পঞ্জিকাই মূলত আমাদের বাংলা পঞ্জিকা। ৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দে রাজা শশাঙ্কের শাসনামলে বাংলা সাল গণনা শুরু হয়। তত দিনে বিক্রম সাম্বাত ক্যালেন্ডারের বয়স ৬৫০ বছর হয়ে গেছে। যখন বিক্রম সাম্বাত ক্যালেন্ডারের সূচনা হয়, তখন লিখিত রূপে বাংলা ভাষা ছিল না। ছিল সংস্কৃত ভাষা। ঠিক যে সময়টাতে বাংলা ভাষার লিখিত রূপ তৈরি হয়, তখনই বাংলা ক্যালেন্ডারের যাত্রা শুরু হয়। বিক্রম সাম্বাত ক্যালেন্ডারকেই বাংলায় লেখা হয়। মাসের নামগুলোও অবিকল তাই আছে।

বৌদ্ধধর্মাবলম্বী দেশ- যেমন: মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, ভুটান, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশও একই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে, অর্থাৎ বৈশাখ মাসের ১ তারিখে নববর্ষ উদ্‌যাপন করে। ওরা এটিকে বলে বৌদ্ধ পঞ্জিকা এবং এর জন্ম বিভিন্ন দেশে কিছুটা ভিন্নতাভেদে যিশুর জন্মের ৫৪৫ থেকে ৫৪৩ বছর আগে। অর্থাৎ বিক্রম সাম্বাত ক্যালেন্ডারের চেয়েও বৌদ্ধ ক্যালেন্ডার আরও ৪৮৮ বছরের পুরোনো। বৌদ্ধ পঞ্জিকা, বিক্রম সাম্বাত পঞ্জিকা কিংবা বাংলা পঞ্জিকা, প্রকৃতপক্ষে একই পঞ্জিকা। সব পঞ্জিকাতেই বৈশাখ, জ্যেষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র—এই নামেই বারো মাসের নাম রয়েছে।

পয়লা বৈশাখ তাই শুধু বাঙালির নববর্ষ নয়, এটি পুরো দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নববর্ষ। বাংলাদেশের সব আদিবাসী এই পঞ্জিকা অনুসরণ করে এবং এটি তাদেরও নববর্ষ।

পাল থেকে সেন, সেন থেকে নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মুসলিম মুঘল সম্রাটদের হাতে চলে যায় ভারতবর্ষের শাসনক্ষমতা। মুঘলরা ক্ষমতায় এসে ইসলামিক বা আরবি ক্যালেন্ডার "হিজরি" অনুযায়ী রাজ্য পরিচালনা করতে শুরু করেন। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবর এবং তাঁর পুত্র দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট নাসিরুদ্দিন মুহম্মদ হুমায়ূন হিজরি সাল অনুযায়ী রাজ্য পরিচালনা করলেও, তৃতীয় মুঘল সম্রাট জালালুদ্দিন মুহম্মদ আকবর চান্দ্র মাসিক ক্যালেন্ডার পাল্টে বাংলা ক্যালেন্ডার পুনঃস্থাপন করেন।

প্রকৃতির শাশ্বত নিয়মেই পুরাতনের বিদায়ে ঘোষিত হয় নতুনের আগমন। প্রাত্যহিকতার সব জীর্ণ ও পুরাতনকে ফেলে রেখে নবসূর্যের উত্তাপ নিয়ে ১৪২৬ থাকুক প্রাণের আশীর্বাদ হয়ে, এমনটাই প্রত্যাশা সবার।

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040