১. চীনের অর্থনীতি সুষ্ঠু ও স্থিতিশীল উন্নয়নের ধারা বজায় রেখেছে। দেশটির জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে চীনের জিডিপি প্রায় ৪৫.০৯ ট্রিলিয়ন ইউয়ানে পৌঁছায়, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬.৩ শতাংশ বেশি।
পরিসংখ্যান অনুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে চীনে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ৭৩.৩ লাখ, যা গোটা বছরের লক্ষ্যমাত্রার ৬৭ শতাংশ। এদিকে, ভোক্তা মূল্যসূচক চলতি বছরের প্রথমার্ধে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২.২ শতাংশ বেড়েছে। পাশাপাশি, দেশের মাথাপিছু ব্যক্তি-আয় পৌঁছেছে ১৫২৯৪ ইউয়ানে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬.৫ শতাংশ বেশি।
বর্তমানে বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীনের অবদান ৩০ শতাংশ। ভবিষ্যতেও চীন বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নের শক্তিশালী চালিকাশক্তি হিসেবে থাকবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, জটিল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে, চীনের অর্থনীতি অব্যাহতভাবে উচ্চমানের উন্নয়নের ধারা বজায় রেখেছে। এই উন্নয়ন চীনের সরকার ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথ প্রচেষ্টার ফল। বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি যেখানে ধীর, সেখানে চীনের অর্থনীতি যেভাবে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে বিশ্বের উচিত চীনের অর্থনীতির ওপর আস্থা রাখা।
২. এদিকে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত চীনের রাজস্ব আয় ১০ ট্রিলিয়ন ইউয়ান ছাড়িয়ে গেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩.৪ শতাংশ বেশি। এদিকে, চীন সরকার বিভিন্ন খাতে কর হ্রাসের নীতিও বাস্তবায়ন করে চলেছে। চীনা অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
পরিসংখ্যান অনুসারে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে জাতীয় রাজস্ব আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬.২ শতাংশ বেশি ছিল। কিন্তু পরের তিন মাসে বেড়েছে মাত্র ০.৮ শতাংশ।
চীনা অর্থ মন্ত্রণালয়ের ট্রেজারি সেন্ট্রাল পেমেন্ট সেন্টারের পরিচালক লিউ জিন ইউন মনে করেন, প্রথমার্ধে রাজস্ব আয় মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। কর হ্রাসের কারণে রাজস্ব আয় তেমন বাড়েনি, যা যুক্তিযুক্ত।
উল্লেখ্য, চলতি বছর চীন বিভিন্ন খাতে কর হ্রাসের বিস্তারিত ব্যবস্থা গ্রহণ করে তা কার্যকর করে। চীনা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর প্রশাসন বিভাগের পর্যবেক্ষক স্যু কুও চেন বলেন, ২০১৯ সালের প্রথমার্ধে কর হ্রাসের ব্যবস্থা কার্যকর হয়েছে। এতে আরেক ধাপে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপ কমেছে এবং নাগরিকদের আয় বেড়েছে।
৩. গত ১৫ জুলাই চীনের প্রধানমন্ত্রী লি খ্য ছিয়াং বেইজিংয়ে অর্থনীতিবিদ ও শিল্পপতিদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। মতবিনিময়-সভায় অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয় এবং প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত প্রতিনিধিদের কাছ থেকে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পরামর্শ ও প্রস্তাব শোনেন।
সভায় লি খ্য ছিয়াং বলেন, চলতি বছরে চীনের অর্থনীতি স্থিতিশীলভাবে সামনে এগিয়ে চলেছে এবং উন্নয়ন হচ্ছে। শহরে ৭২ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এবং নাগরিকদের আয় বেড়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশও কিছুটা উন্নত হয়েছে। এমন সাফল্য অর্জন সহজ ব্যাপার ছিল না।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি দুর্বল, বাণিজ্যিক বিনিয়োগ মন্থর, এবং বাণিজ্যে সংরক্ষণবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। এসব নেতিবাচক প্রবণতা চীনের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলছে। এমন প্রেক্ষাপটে, অর্থনৈতিক কাঠামো আপগ্রেড করা, অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, এবং উচ্চ মানের উন্নয়ন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
৪. চীনা পণ্যের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে ভর্তুতি-বিরোধি তদন্ত করা থেকে বিরত থাকতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আবারও আহ্বান জানিয়েছে বেইজিং। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জনৈক মুখপাত্র সম্প্রতি এ আহ্বান জানান।
সম্প্রতি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয় চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যেসব ভর্তুকি-বিরোধী তদন্ত করে ব্যবস্থা নিয়েছে, সেগুলোর ১১টি ক্ষেত্রেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়েছে। চীন নিজের শিল্প ও পণ্যের স্বার্থ রক্ষার্থে বিষয়টি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নজরে আনে।
মুখপাত্র বলেন, চীন বহুপক্ষীয় বাণিজ্যের নিয়মকে সম্মান করে এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেওয়ার প্রবণতার বিরোধিতা করে।
৫. চলতি বছরের প্রথমার্ধে চীনের সামাজিক ফাইন্যান্সিং তথা ব্যক্তি ও অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক খাত থেকে প্রাপ্ত তহবিল ১৩ ট্রিলিয়ন ইউয়ান ছাড়িয়েছে। চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান লুয়ান চিয়ে হং বলেন, ২০১৯ সালের প্রথম ৬ মাসে সামাজিক ফাইন্যান্সিংয়ের পরিমাণ ছিল ১৩.২৩ ট্রিলিয়ন ইউয়ান, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩.১৮ ট্রিলিয়ন ইউয়ান বেশি। এর মধ্যে ঋণের পরিমাণ কমেছে ও সরাসরি বিনিয়োগ বেড়েছে।
ব্যাংক আরও জানায়, চলতি বছরের প্রথমার্ধে রেনমিনপির সুদের হার তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ছিল।
৬. চীনের জাতীয় বাজার তত্ত্বাবধান ব্যবস্থাপনা সাধারণ ব্যুরোর খাদ্য উত্পাদন নিরাপত্তা তত্ত্বাবধান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের মহাপরিচালক মা ছুন লিয়াং সম্প্রতি দশম চীনা দুগ্ধ শিল্প সম্মেলনে বলেন, চীনের উত্পাদিত দুগ্ধজাতীয় খাদ্য আন্তর্জাতিক মানের। দেশের দুগ্ধ শিল্প খাতে ঝুঁকি মোকাবিলায় ও মান সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান চালু করা হয়েছে এবং জরুরি তত্ত্বাবধান-ব্যবস্থাও কার্যকর আছে।
সম্মেলনে চীনের দুগ্ধ শিল্প সমিতির প্রধান লি তে ফা বলেন, ২০১৮ সালে গোটা চীনে দুগ্ধজাতীয় খাদ্যের উত্পাদনের পরিমাণ ছিল ৩১৭ লাখ ৬৮ হাজার টন, যা ১৯৪৯ সালের ১৪৬ গুণ। এসময় দুগ্ধজাতীয় খাদ্য উত্পাদনের সঙ্গে জড়িত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৫৮৭টি। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ওই বছর ৩৩৯.৮৯ বিলিয়ন ইউয়ান মূল্যের পণ্য বিক্রি করেছে।
এদিকে, চীনে দুগ্ধজাতীয় খাদ্যের ভোক্তাদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ২০১৮ সালে চীনে দুগ্ধজাতীয় পণ্যের মাথাপিছু ভোগের পরিমাণ ছিল ৩৪.৩ কিলোগ্রাম, যা ১৯৪৯ সালের ৭৬ গুণ।
৭. প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি টুইটারে এক পোস্টে বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ধীর হওয়ার কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করতে আগ্রহী চীন। তাঁর এ দাবি সম্পূর্ণ ভুল। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কেং শুয়াং বেইজিংয়ে নিয়মিত সাংবাদিক সম্মেলনে এ কথা বলেন।
ট্রাম্প টুইটারে বলেন, এ বছরের এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ২৭ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ধীর ছিল। হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান চীন থেকে নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। সেজন্য চীন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর করতে চায়।
এ সম্পর্কে কেং শুয়াং বলেন, এ বছরের প্রথমার্ধে চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬.৩ শতাংশ ছিল। এটি হলো একটি ভাল সাফল্য। এক্ষেত্রে সারা বিশ্বের মধ্যেই এগিয়ে আছে চীন। চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক সত্তা। দেশটি বিশ্বের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে ৩০ শতাংশেরও বেশি অবদান রাখছে। চীনা অর্থনীতির স্থিতিশীল উন্নয়ন বরং যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও বিশ্বের অর্থনীতির জন্য অনুকূল।
মুখপাত্র বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত পারস্পরিক সম্মান ও কল্যাণের ভিত্তিতে ও সংলাপের মাধ্যমে বাণিজ্যিক মতভেদ দূর করা এবং একটি অভিন্ন কল্যাণের চুক্তি স্বাক্ষর করা।
৮. চীন থেকে সাম্প্রতিককালে যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান ব্যবসা অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে, তাদের সংখ্যা বেশি নয় এবং সেগুলো মূলত মধ্যম ও নিম্ন পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের স্থানান্তর চীনা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি, শিল্পের উন্নয়ন, ও কর্মসংস্থানের ওপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না। চীনা জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিটির মুখপাত্র মেং ওয়েই বেইজিংয়ে নিয়মিত সাংবাদিক সম্মেলনে এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ কার্যকর হওয়ার পর থেকে চীনে স্থাপিত বিভিন্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠানের সাফল্য একটি বাস্তবতা। চীন সারা বিশ্বে কম দামে উন্নতমানের পণ্য সরবরাহ করে আসছে বহুবছর ধরেই। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীনের শিল্প-কাঠামোয় পরিবর্তন ও পণ্যের মানের ক্ষেত্রে আরও কড়াকড়ি আরোপ করায় কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। এটা স্বাভাবিক।
তিনি আরও বলেন, পরবর্তী পর্যায়ে চীনা জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিটি দেশে আন্তর্জাতিক প্রথম পর্যায়ের ব্যবসা-পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করবে। ধারাবাহিক ব্যবস্থা কার্যকর হওয়ার পর অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান অব্যাহতভাবে চীনে ব্যবসা করে যাবে এবং আরও বেশি বিদেশি প্রতিষ্ঠান চীনে বিনিয়োগ করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
৯. বিদেশ থেকে ইউরেনিয়াম আমদানির ওপর আপাতত কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করবে না যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি এ কথা জানান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর আগে মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইউরেনিয়াম আমদানি প্রসঙ্গে তদন্ত চালিয়ে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, বিদেশ থেকে ইউরেনিয়াম আমদানি দেশের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।
তবে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওই সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, এ বিষয়ে আরও তদন্ত হওয়া দরকার। তা ছাড়া, দেশে ইউরেনিয়াম উত্পাদন বাড়াতে একটি কর্মগ্রুপ গঠনের কথাও বলেন তিনি।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে তার চাহিদার ৯০ শতাংশ বাণিজ্যিক ইউরেনিয়াম বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে।
১০. ফেসবুক-এর প্রস্তাবিত ক্রিপ্টোকারেন্সি 'লিবরা' নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্টিভেন মুচিন। সম্প্রতি হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্বেগের কারণ, লিবরা মানি লন্ডারিং বা সন্ত্রাসবাদী তত্পরতায় ব্যবহৃত হতে পারে।
তিনি বলেন, বিটকয়েন-সহ বিভিন্ন ক্রিপ্টোকারেন্সি সাইবার অপরাধ, শুল্কফাঁকি, চাঁদাবাজি, মাদক ও মানুষ পাচারে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা একটি জাতীয় নিরাপত্তা সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
মন্ত্রী আরও বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচিত বিটকয়েন ও লিবরাসহ বিভিন্ন ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার তত্ত্বাবধানে নির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা।
উল্লেখ্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ২০২০ সাল নাগাদ 'লিবরা' নামক ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে আসবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
(আলিমুল হক)