চীনের এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তার ২৮ বছর ধরে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তার গল্প এবং চীনের ফুটবল বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন স্কুলের উন্নয়ন
  2019-08-05 14:04:22  cri

 


২৮ বছর ধরে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা করছেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা সিয়াও কুয়াং শেং

সিয়াও কুয়াং শেংয়ের বর্তমান বয়স ৯০ বছর। তিনি খুব সাধারণ জীবনযাপন করেন। যুব বয়সে তিনি তাঁর পায়ে একবার আঘাত পেয়েছিলেন, তাকে এখনো সেই আঘাত নিয়ে চলাফেরা করতে হয়। এ পরিস্থিতিতে ৯০ বছর বয়সেও বিশ্রাম না নিয়ে তিনি দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা করে চলেছেন।

গত ২৮ বছর ধরে বাসে বা ভাড়া করা গাড়িতে আশেপাশের শতাধিক জেলায় যাতায়াত করছেন সিয়াও কুয়াং শেং। তিনি নিজের বেতন থেকে ১.৬ লাখেরও বেশি ইউয়ান ও অন্যদের কাছ থেকে ৮৪ লাখ ৫৫ হাজার ইউয়ান তহবিল সংগ্রহ করে ১১১২ জন দরিদ্র শিক্ষার্থীকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। তার পুরনো বাড়ির দেওয়ালটিতে ওই সব শিক্ষার্থীদের ছবি টাঙ্গানো, যাদের তিনি আর্থিক সহায়তা করেছেন।

তিনি দেওয়ালে টাঙ্গানো ছবি দেখে প্রত্যেকের দুঃখজনক গল্প সাংবাদিকের কাছে শেয়ার করেন। তিনি মুগ্ধভাবে বলেন যে, 'অনেক বাচ্চাকে সহায়তা দেওয়ার পর আমি আমার নিজের নামও তাদের কাছে প্রকাশ করি নি। আমি শুধু এমন কাজে যোগাযোগের কাজ করেছি।'

 

চীনের হুনান প্রদেশের লিয়ানইউয়ান শহরের রাজস্ব বোর্ডের একজন কর্মকর্তা হিসেবে জনাব সিয়াও আরামদায়কভাবে অবসর জীবন কাটাতে সক্ষম। তবে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সাথে পরিচয় হওয়ার কারণে তাঁর জীবনে অনেক পরিবর্তন ঘটে।

১৯৯১ সালের শীতকালে জনাব সিয়াও একটি দূরবর্তী পাহাড়ি অঞ্চলের গ্রামে গিয়ে কৃষক বন্ধুর সাথে দেখা করেন। বন্ধুর ছেলে বিদ্যুত্স্পৃষ্টে মারা গেছে, এরপর ছেলের বউ এ বাড়ি থেকে চলে যায়। তখন বাড়িটিতে শুধু ওই বন্ধু ও তার অল্পবয়সী নাতি বাস করে। তাঁদের জীবনযাপন অনেক কষ্টের। সেজন্য বাচ্চার লেখাপড়ার খরচ বহন করতে পারেন না। তখন জনাব সিয়াও নিজের পকেট থেকে ৫০০ ইউয়ান বের করে বন্ধুকে দেন। তিনি মনে করেন, কষ্ট করে জীবনযাপন করলেও বাচ্চার লেখাপড়া বন্ধ করা যাবে না।

তখন থেকে তিনি খেয়াল করেন যে, তার বন্ধুর মতো আরো অনেক পরিবার আর্থিক সমস্যার কারণে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে পারে না। তখন তিনি ভাবতে থাকেন কিভাবে তিনি তাদেরকে সাহায্য করতে পারেন। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি অর্থ সংগ্রহ করে দরিদ্র বাচ্চাদের সহায়তা দেবেন। তিনি পরিকল্পনা করেন, ১০ বছরে তিনি এ কাজে ১ লাখ মানুষকে উত্সাহ দিয়ে ১০ লাখ ইউয়ান তহবিল সংগ্রহ করবেন এবং এ অর্থ তিনি ১০০ জন দরিদ্র বাচ্চাকে সহায়তা দেবেন।

বাসায় ফিরে তিনি পরিচিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সাথে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর তারা ধীরে ধীরে এ ব্যাপারে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। একবার ১৪ বছর বয়সী অনাথ মেয়ে কুও ছুন হুয়া লিউকেমিয়া রোগে আক্রান্ত হলে তখন প্রবীণরা মেয়টির জন্য ১.১৬ লাখেরও বেশ ইউয়ান সংগ্রহ করেন। তাছাড়া, লিয়ানইউয়ান শহরের রাষ্ট্রীয় শুল্ক ব্যুরোর অস্থায়ী কর্মী উ চেং সিয়ান যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, তখন তার প্রাথমিক স্কুল পড়ুয়া ছেলেকে সহায়তার উদ্যোগ নেন জনাব সিয়াও। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ছেলেটিকে ২০০০ ইউয়ান প্রদান করেন এবং স্থানীয় শিল্পপতি জনাব উ সিউ জিকে ছেলেটির লেখাপড়ার জন্য আর্থিক সহায়তা করার অনুরোধ জানান। ফলে ওই ছেলের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত খরচ বহন করেন শিল্পপতি উ।

লিয়ানইউয়ান শহরের শাসনে ২০টি জেলা ও উপজেলায় প্রায় ১০০টি দরিদ্র গ্রাম রয়েছে। তিনি বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে ঘুরে স্থানীয় দরিদ্র পরিবারের বিস্তারিত তথ্য লিপিবদ্ধ করেন। পরে তিনি সরকারি অফিস, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও অলাভজনক সংস্থায় গিয়ে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করেন। গত ২৮ বছরের মধ্যে প্রতি বছর কমপক্ষে ৩০০ দিন তিনি অর্থ সংগ্রহের পথে ব্যস্ত থেকেছেন।

জনাব সিয়াও বিশ্বাস করেন, প্রত্যেক মানুষের মনে আন্তরিক ভালোবাসা রয়েছে।

প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে উচ্চবিদ্যালয়ের পরীক্ষা 'কাওখাও' শেষে জনাব সিয়াওয়ের সবচেয়ে ব্যস্ত সময় আসে। তিনি অর্থ সংগ্রহের জন্য দরিদ্র শিক্ষার্থীদের তথ্য নিয়ে পুরনো সরকারি কর্মকর্তার ইউনিফর্ম পড়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যান। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ছাংশা শহরে ৮টি প্রতিষ্ঠান আছে, সেখানে তাকে একদিনের মধ্যে যেতে হবে। তিনি গ্রীষ্মকালের গরমেও বাসে বসে এসব জায়গায় যাতায়াত করেন।

সাধারণত দাতব্য প্ল্যাটফর্ম চালুর একটা খরচ রয়েছে, তবে জনাব সিয়াও নিজের খরচে দাতব্য কাজ করেন। যাতায়াত, থাকা-খাওয়া, কাগজ প্রিন্টিংসহ সব কাজে তিনি নিজের অর্থ খরচ করেন। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি কখনো অন্যের বাড়িতে খাবার খান না, টাকা সঞ্চয় করতে তিনি সাধারণত একদিনে শুধু পানি আর রুটি খান। হাঁটাহাঁটি করতে সক্ষম হলে কখনো বাসে উঠেন না।

জনাব সিয়াওয়ের স্ত্রী ম্যাডাম লিউ মু কুই'র চোখে তিনি শুধু নিজের খরচের ব্যাপার খেয়াল করেন, তবে অন্যদের সহায়তার ব্যাপারে তিনি কখনো অর্থের হিসাব করেন না। বহু বছর ধরে জনাব সিয়াও মোট ১.৬ লাখ ইউয়ান প্রদান করেছেন, আর তাঁর তিন ছেলে-মেয়েও বাবার মতো তিনটি দরিদ্র পরিবারের বাচ্চাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স সম্পন্ন করা পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা করেন।

২০০৫ সালে জনাব সিয়াও আনন্দের সাথে জীবনের প্রথম 'দশ বছরের পরিকল্পনা' সম্পন্ন করেন। তখন তিনি ১.১ লাখেরও বেশি মানুষকে উত্সাহ দিয়ে মোট ১০ লাখ ১২ হাজার ইউয়ান সংগ্রহ করেন এবং মোট ১০৮ জন বাচ্চাকে সহায়তা দেন। ২০০৯ সালে তিনি পরিকল্পনার চেয়ে অনেক আগে দ্বিতীয় 'দশ বছরের পরিকল্পনা' সম্পন্ন করেন। তখন ৩ লাখেরও বেশি মানুষকে উত্সাহ দিয়ে ৩০ লাখ ইউয়ান সংগ্রহ করেন এবং মোট ৩০০ জনকে সহায়তা দেন।

২০০৯ সালে জনাব সিয়াও ৮০ বছর বয়সে পদার্পণ করেন। তাঁর আত্মীয়স্বজন তাঁকে বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দেন।তবে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞায় বলেন যে, 'আমার বয়স ৮০ বছর হয়েছে, তাই সময় আমার কাছে অনেক শ্রেষ্ঠ, আমি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অন্যদের সহায়তা করতে চাই।'

২০১১ সালের এপ্রিল মাসে লিয়ানইউয়ান শহরের ছিসিং জেলার থুজু গ্রাম থেকে বাসায় ফেরার পথে হঠাত্ পড়ে গিয়ে ডান পায়ে আঘাত পান জনাব সিয়াও। তবে হাসপাতালে মাত্র এক মাস বিশ্রাম নেওয়ার পর তিনি আবার লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটাহাঁটি শুরু করেন! তখন তিনি বলেন, 'আমি আর অপেক্ষা করতে পারি না, থুজু গ্রামের অসুস্থ শিক্ষক আমার অপেক্ষা করছেন'।

২০১৪ সালের মে মাসে তাঁর তৃতীয় দশ বছরের পরিকল্পনাও সম্পন্ন হয়। বর্তমানে জনাব সিয়াও স্থানীয় অঞ্চলের দাতব্য ব্যক্তি হিসেবে সবার কাছে ব্যাপক সম্মানীয়। যারা সমস্যার সম্মুখীন হন, তারা জনাব সিয়াওয়ের কাছে সহায়তার আবেদন করেন।

জনাব সিয়াওয়ের জন্য সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার হল তাঁর উদ্যোগে আর্থিক সহায়তা দেওয়া ১০৫১ জন দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫১৭ জন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন এবং তাদের মধ্যে ৩৮০ জন অনাথ ও চরম দরিদ্র পরিবারের বাচ্চা। এ পর্যন্ত ১০১ জন ডক্টরেট ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন, তাদের মধ্যে ২৩ জন অনাথ। আরো ২১০ জন মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। জনাব সিয়াও বলেন, 'তারা দেশের দক্ষ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে দেখে আমি অনেক গৌরব বোধ করি'।

বর্তমানে ৯০ বছর বয়সী জনাব সিয়াওয়ের নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে। তা হল ২০০ জন দরিদ্র শিক্ষার্থীকে মাস্টার্স ও ডক্টরেট ডিগ্রি সম্পন্ন করতে সহায়তা দেওয়া। তিনি বলেন, 'যদিও আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি, তবে আমার আশা ও প্রতিজ্ঞা অনেক দৃঢ়। আমার প্রচেষ্টার শক্তি অনেক বেশি, আর অভিজ্ঞতাও অনেক সমৃদ্ধ, আমি সকল প্রচেষ্টা চালিয়ে এ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করবো!


1  2  
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040