৩০ বছরে চামড়ার সর্বনিম্ন দাম : বাংলাদেশে চামড়াশিল্পে অশনি সংকেত
  2019-08-18 19:02:46  cri

কোরবানির চামড়া কেনা-বেচা নিয়ে এবার বড় একটা তেলেসমাতি ঘটে গেলো বাংলাদেশে! গত ৩০ বছরের মধ্যে এবার কোরবানীর চামড়ার দাম ছিল সর্বনিম্ন। সরকার কোরবানির আগে দাম বেধে দিলেও কাজ হয়নি। দাম না পেয়ে দেশের অনেক জায়গায় চামড়া ফেলে দিয়েছে মানুষজন। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসহায় দুঃস্থ মানুষ, এতিমখানা ও বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। আর অন্যদিকে দেশের চামড়াশিল্পের জন্যও এটি একটি অশনি সংকেত।

কিন্তু কেন এবার চামড়া নিয়ে এমন মন্দদশা ঘটলো? প্রতি বছর যে পরিমাণ চামড়া কেনা হয় তার বেশিরভাগই হয় কোরবানির ঈদের সময়। এবার এককোট পিস চামড়া কেনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। তবে, নানা কারণে গত কয়েক বছর ধরেই চামড়ার দাম কম ছিল। সরকার কোরবানির আগে গরুর চামড়া রাজধানীতে ৪০-৪৫ টাকা বর্গফুট আর ঢাকার বাইর প্রতি বর্গফুট ৩৫-৪০ টাকা ধার্য করে দেয়। সারাদেশে খাসির চামড়া ১৮-২০ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৩-১৫ টাকা বর্গফুট ধার্য করে দেয়।

কিন্তু ঈদের দিন কোরবানির চামড়ার ব্যাপক দরপতন লক্ষ্য করা যায়। যে চামড়ার দাম ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা হওয়ার কথা সে চামড়া বিক্রি হয়েছে ৩ থেকে ৪ শো টাকায়। কোথাও কোথাও কোনো ক্রেতাই ছিল না। ঈদের পর পাড়া-মহল্লায় মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ফড়িয়াদের উপস্থিতি ছিল কম। বিক্রেতারা অভিযোগ করেন ব্যবসায়ী-আড়তদাররা সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমিয়েছেন। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন নগদ টাকার সংকট ও ঋণ না পাওয়া তারা চামড়া কিনতে পারেননি। কোরবানির মোট চামড়ার ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ নষ্ট হয়ে যায় এতে করে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার তরিৎ সিদ্ধান্ত নেয় কাঁচা চামড়া রপ্তানির। ১৪ আগস্ট বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী জানান, ঈদের আগে ট্যানারি মালিক ও চামড়া ব্যবসায়ীদের নিয়ে সভা করে চামড়ার দাম ঠিক করে দিলেও তারা সরকারের সিদ্ধান্ত মানেননি। দাম এতই কম ছিল যে তা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই সরকার বাধ্য হয়ে কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায় চামড়া ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা। আর অন্যদিকে এর বিরোধিতা করে ট্যানারি মালিকরা। এরই এক পর্যায়ে বকেয়া পরিশোধের দাবিতে ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়া বিক্রি বন্ধ রাখে আড়তদাররা। ১৭ আগস্ট থেকে চামড়া কেনাবেচা শুরুর কথা ছিল। বাংলাদেশ হাইড এন্ড স্কিন মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি দেলোয়ার হোসেনের দাবি তারা ট্যানারি মালিকদের কাছে ৩০০ কোটি টাকা পাবেন। অন্যদিকে বাংলাদেশ টেনার্স এসোসিয়েশন জানায়, পাওনা দেড় শো কোটি টাকা হবে। তবে, গত বছরের চামড়া বিক্রি করতে না পারায় তারা বকেয়া পরিশোধ করতে পারেননি।

উদ্ভূত পরিস্থিতি আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের বিবাদ মেটানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। চামড়া কেনাবেচা নিয়ে উদ্ভুত এ সমস্যা হয়তো মিটে যাবে। এবার চামড়ার দাম কম হওয়ার সাময়িক ক্ষতিও হয়তো কাটিয়ে ওঠা যাবে। কিন্তু চামড়া শিল্পের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়ন এখন প্রধান উদ্বেগের বিষয়।

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ১০২ কোটি ডলার। ২০২১ সালের মধ্যে রপ্তানি আয় ৫০০ কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। কিন্তু অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না। গত কয়েক বছর ধরে এ খাতে রপ্তানি আয় ক্রমাগতভাবে কমছে। কিন্তু কেন এ খাতে এমন দুর্দশা?

চামড়াশিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের চামড়ার সবচেয়ে বড় ক্রেতা চীন আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। আর পরিবেশবান্ধব না হওয়ায় ভারত ও জাপানের ক্রেতারাও চলে গেছে বাংলাদেশ ছেড়ে। এমনকি বাংলাদেশের বড় বড় কোম্পানিগুলো বিদেশ থেকে চামড়া আমদানি করে পণ্য তৈরি করছে। এ সবই চামড়া শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

রাজধানীর হাজারিবাগ থেকে চামড়া শিল্প সাভারের হেমায়েতপুরে সরিয়ে নিলেও এখনো সেটি পূর্ণাঙ্গ রূপে চালু করা যায়নি। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন-বিসিক চেয়ারম্যান মো. মোশতাক হাসানও স্বীকার করেছেন এ সীমাবদ্ধতা।

সমস্যা চিহ্নিত করা গেলে তার সমাধান সম্ভব। বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের সমস্যা যেহেতু চিহ্নিত করা গেছে তারও সমাধানও সম্ভব। সংশ্লিষ্ট সকল মহলের যথাযথ উদ্যোগে এ দুর্দশা থেকে দেশের সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্পের উত্তরণ ঘটবে বলে আশা সকলের।

ঢাকা থেকে মাহমুদ হাশিম।

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040