পানিসম্পদের স্মার্ট ব্যবহার: নিংসিয়া উন্নয়নের গোপন রহস্য
  2020-01-15 15:57:23  cri

নিংসিয়ার সিহাইকু অঞ্চলে এমন একটি কথা প্রচলিত ছিল: এখানে ১০ ধরনের ফসল চাষ করা হলে ৯টি মারা যায় এবং চড়ুই পিপাসা পেলে ডিজেল খায়। এ কথার দ্বারা এতদঞ্চলের অনাবৃষ্টিকেই আসলে বর্ণনা করা হতো। এখানে মাথাপিছু পানিসম্পদের পরিমাণ জাতীয় মানের ২২ ভাগের এক ভাগ মাত্র।

সিহাইকু অঞ্চলে পানীয় জলের অভাব ছিল একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। স্থানীয় প্রবীণরা বলেন, বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে স্থানীয় মানুষ মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার সময় দেখতো ছেলের বাড়িতে কোনো জলাধার আছে কি নেই! কারণ এখানে তখন বাড়িঘর ও ক্ষেতের চেয়ে পানি ছিল বেশি মূলব্যান!

৬৩ বছর বয়সী হান শেন ছাং সিহাইকু অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি বলেন প্রতিবার পানি আনার জন্য ২ ঘন্টার মতো হাঁটতে হতো। সেই সংগৃহীত পানিও মাত্র দু'একদিনে শেষ হতো। শীতকালে পানি আনতে যেতে হলো লোহার রড নিয়ে। কারণ, তখন ঠাণ্ডায় সব বরফ হয়ে যেতো। লোহার রড দিয়ে বরফ ভেঙে তা সংগ্রহ করা হতো।

এখানকার পানির অভাব মেটাতে বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে কেন্দ্রীয় সরকার ও নিংসিয়া হুই স্বায়ত্তশাসিত এলাকার সরকার একাধিক উদ্যোগ নেয়। উদ্যোগগুলোর মধ্যে ছিল: বাঁধ নির্মাণ, বড় আকারের কূপ খনন করা; বাড়ির ছাদে যত বেশি সম্ভব বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করা, ইত্যাদি। এতে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও, বৃষ্টি কম হলে সংকট ঠিকই তীব্রতর হয়ে উঠতো।

২০১২ সালে নিংসিয়ায় শুরু হয় মধ্য ও দক্ষিণ শহর ও জেলা পানি নিরাপত্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। প্রকল্পের আওতায় বন্যার মরশুমে চিং হ্য নদীর পানি অন্য জায়গায় পাঠানো হয়। ২০১৬ সালে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শেষ হয় এবং ১১ লাখ মানুষ এ থেকে উপকৃত হয়। এ সংখ্যা নিংসিয়াং মোট লোকসংখ্যার ৬ ভাগের একটি ভাগ। এর মধ্যে কু ইউয়ান শহরের চং চুয়াং জলাধার বৃহত্তম একটি জলাধার। এর পানিধারণ ক্ষমতা আড়াই কোটি কিউবিক মিটার। এখান থেকে দশ-বারো কিলোমিটার লম্বা পাইপের মাধ্যমে পানিকে খরাপ্রবণ জেলা ও গ্রামে পাঠানো হয়। পাইপগুলো পাহাড়ের মধ্য দিয়ে যাওয়ায়, সেগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। ইন্টারনেট এ সমস্যা সমাধান করে। পানির উত্স, জলের মিটার, ব্যবহারকারীর তথ্য সবকিছু একটি সিস্টেমে যুক্ত করা হয় এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সারা প্রক্রিয়াকে মনিটর করে এ সিস্টেম। আগে পাইপের কোনো সমস্যা হলে সংশ্লিষ্ট কর্মীকে পাহাড়ে এক এক জায়গায় গিয়ে চেক করতে হতো। এখন সিস্টেম সক্রিয়ভাবে পাইপের সমস্যা ও অবস্থান কর্মীকে জানিয়ে দেয়।

নিংসিয়া হুয়াং হ্য নদীর প্রবাহিত অঞ্চল এবং হাজার হাজার বছর আগ থেকে স্থানীয় মানুষ হুয়াং হ্য নদী থেকে পানি নিয়ে জলসেচন করে আসছে। ২০১৭ সালে, নিংসিয়াং পুরাতন হুয়া হ্য জলসেচন এলাকা আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব জলসেচন প্রকল্প ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। এটা হুয়া হ্য নদী প্রবাহিত এলাকার প্রথম বিশ্ব জলসেচন ঐতিহ্য।

নিংসিয়ায় হুয়াং হ্য নদী জলসেচন এলাকার আয়তন গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার আগের ১০ লাখ মু থেকে বর্তমানে ৯০ লাখ মুতে উন্নীত হয়েছে। হংসিপাও নামের একটি জায়গা একসময় আর্টিলারি প্রশিক্ষণ গ্রাউন্ড ছিল। ২০ বছরের প্রচেষ্টায় এটা এখন ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষের সুখের বাসস্থান। ২ লাখ ৩০ হাজার দরিদ্র মানুষকে এখানে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। শূন্য থেকে শুষ্ক এ ভূমিতে নিজেদের সুখী জীবন তৈরি করেন তারা।

শীতকালে হংসিপাওয়ে উত্পাদিত মূলা দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে রফতানি হয়। ৬ হাজার মু জমিতে ড্রিপ সেচ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় এবং এক মু জমিতে জলসেচ করতে মাত্র ২৪০ কিউবিক মিটার পানি লাগে, যা সাধারণ জলসেচ প্রযুক্তির তুলনায় অর্ধেক পানি সাশ্রয় করে। প্রতিবছর উত্পাদিত মুলার মোট মূল্য ৩ কোটি ইউয়ান এবং এ থেকে কাছাকাছি ৬টি গ্রামের ১৫০০ জন কৃষক ৮০ লাখ ইউয়ান আয় করতে পারেন।

নিংসিয়া চীনের গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গুর এবং বেরি উত্পাদন এলাকা এবং এর চাষেও ব্যবহার করা হয় ড্রিপ সেচপ্রযুক্তি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে নিংসিয়া উচ্চ কার্যকর জলসেচনের আওতায় আছে ৩৫ লাখ মু জমি। ২০২০ সালের শেষ নাগাদ যা ৪০ লাখ মু হবে।

কৃষির উন্নয়ন পানির উপর নির্ভর করে এবং শিল্পের জন্যও পানি গুরুত্বপূর্ণ। পানি ব্যবহারে তাই যেমন সাশ্রয়ী হতে হয়, তেমনি এর ব্যবহার হতে হয় কার্যকরী। নিংসিয়ায় কৃষিকাজে লাগানোর পর যেটুকু পানি সাশ্রয় হয়, তা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রয় করা হয়ৰ। এর আয় আবার জলসেচ স্থাপনা প্রতিষ্ঠায় ব্যয় করা হয়।

নিংসিয়ার রাজধানী ইন ছুয়ানর অধিকাংশ পার্কের নামের সঙ্গে সাগর বা হ্রদ শব্দটি আছে। এমনকি শহরের হোটেলগুলোর নামও পানিসম্পর্কিত শব্দ বেশ ব্যবহৃত হয়। নিংসিয়ার সাহিত্যকর্মেও পানি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

প্রাচীনকালে ইনছুয়ানের হ্রদ ও জলাভূমি ছিল অনেক। তাই এটি পরিচিত ছিল ৭২ সংযুক্ত হ্রদের নগর। তবে শহর উন্নয়নের সাথে সাথে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে শহরে প্রাকৃতিক হ্রদের সংখ্যা মাত্র ১০টিতে দাঁড়ায়।

৭২টি সংযুক্ত হ্রদের দৃশ্য পুনরুদ্ধারের জন্য ইন ছুয়ান সরকার দূষণপ্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ এবং জলাভূমি পনুরুদ্ধারসহ নানান ব্যবস্থা নেয়। এখন ইন ছুয়ান শহরে শতাধিক মুর চেয়ে বড় হ্রদের সংখ্যা ১৩০টির বেশি।

পাশাপাশি নিংসিয়ার অন্য শহরে পানিসম্পদ সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে আরও সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। উ ছং শহরে পাখি দ্বীপ নামে একটি জায়গায় ১২০ হাজার মু জলাভুমি উদ্ধার করা হয়েছে এবং ১৮৭ ধরনের পাখি এখানে বাস করে। কু ইউয়ান শহরে দূষিত নদী আবার পরিষ্কার হয়েছে এবং মানুষ নদীর তীরে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে। নিংসিয়ায় পানি ব্যবহারের পরিমাণ কম হলেও এখানকার অর্থনীতি ও সমাজের উন্নয়ন ঘটেছে অনেক।

দ্বাদশ পাঁচসালা পরিকল্পনা চালু হবার পর নিংসিয়ায় লোকসংখ্যা ও জিডিপি যথাক্রমে ৫৬০ হাজার ও ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। অথচ এখানে পানির ব্যবহার ৬২ কোটি কিউবিক মিটার কম।

চীনা মানুষ হুয়াং হ্য-কে মাতৃনদী ডাকে। ভবিষ্যতে নিংসিয়ায় চালু হবে মাতৃনদী সংরক্ষণ, পানিড নেটওয়ার্ক আপগ্রেডেশান, জলসেচন দারিদ্র্যবিমোচনসহ নানান প্রকল্প। পাশাপাশি, এখানে পানিসম্পদ উদ্ধার, ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার নতুন পদ্ধতি ও শিল্প স্থাপিত হবে। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040