২০১৯ সালে উত্তর আমেরিকায় চীনা চলচ্চিত্র
  2020-01-16 13:21:34  cri

স্থিতিশীল গতিতে উত্তর আমেরিকার ফিল্ম মার্কেট উন্নত করা হলো চীনের শক্তিশালী চলচ্চিত্র শিল্পের দীর্ঘদিনের লালিত ইচ্ছা।

২০১৯ সালের দিকে ফিরে তাকালে আমরা দেখি, চীনের অনেকগুলো চলচ্চিত্র উত্তর আমেরিকার সিনেমা হলে প্রদর্শিত হয়েছিলো। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র উত্তর আমেরিকার চীনা কমিউনিটিতে আলোড়ন তৈরি করেছিলো। একে অনেকটা অপ্রত্যাশিত হয় বলে মনে হয়। কিন্তু বক্সঅফিস ও সমাজের মূল অংশে চীনা ছবির প্রভাব এ দুটি ক্ষেত্রে চীনের চলচ্চিত্রের ভূমিকা তেমন সন্তোষজনক ছিলো না। হলিউডের বিশাল খরচের তৈরি ফিল্মের তুলনায় এর সুস্পষ্ট ব্যবধান চোখে পড়ে।

বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, চীনা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে চীনা কমিউনিটির বাইরে উত্তর আমেরিকার আরও বেশি দর্শক আকর্ষণ করতে চাইলে নির্মাণ ও প্রচারণাসহ বিভিন্ন দিক উন্নত করতে হবে।

আমরা লক্ষ্য করেছি যে, ২০১৯ সালে অনেকগুলো চীনা চলচ্চিত্র উত্তর আমেরিকার সিনেমা হলে প্রদর্শিত হয়েছিল। ২০১৯ সালে উত্তর আমেরিকায় প্রদর্শিত চীনা চলচ্চিত্রের সংখ্যা ২০১৮ সালের চেয়ে সুস্পষ্টভাবে বেড়েছে। বেশিরভাগ চলচ্চিত্র চীনে প্রচারের পাশাপাশি বিদেশি সিনেমাহলে প্রদর্শিত হয়েছে।

২০১৮ সালের তুলনায় উত্তর আমেরিকার গোটা চলচ্চিত্র বক্সঅফিস প্রায় ৪ শতাংশ হ্রাস পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে চীনা চলচ্চিত্রের বক্সঅফিসে স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি বজায় ছিলো। হুয়াসিয়া ফিল্ম ডিসট্রিবিউশন কর্পোরেশন, 'ওয়েল গো ইউএসএ'সহ বিভিন্ন প্রযোজনা সংস্থার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।

২০১৯ সালে হুয়াসিয়া ফিল্ম ডিসট্রিবিউশন কর্পোরেশন 'দ্য ওয়াডারিং আর্থ', 'পেগাসুস' এবং 'মাই পিপল, মাই কান্ট্রি'সহ ১১টি চীনা চলচ্চিত্র তৈরি করে। ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত বক্সঅফিসের মোট আয় ১ কোটি ৬ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায়। ২০১৮ সালে হুয়াসিয়া ফিল্ম ডিসট্রিবিউশন কর্পোরেশনের উদ্যোগে উত্তর আমেরিকায় মোট ৫টি চীনা চলচ্চিত্র প্রকাশিত হয় এবং বক্সঅফিসে এর আয় ছিল ৭ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার।

ওয়েল গো ইউএসএ'র মতো আরেকটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা 'নে চা', 'বেটার ডেইস' 'আইপি ম্যান ফোর'সহ ১৪টি চীনা চলচ্চিত্র প্রকাশ করেছে। ২০১৯ সালে এবং বক্সঅফিসের এগুলো ৯৮ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার আয় করে। ২০১৮ সালে এই কোম্পানির উদ্যোগে মোট ৯টি চীনা চলচ্চিত্র প্রকাশিত হয় এবং বক্সঅফিসে মোট আয় ৪০ লাখ ১০ হাজার মার্কিন ডলার।

এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০১৯ সালে চীনের বক্সঅফিসের তালিকার চ্যাম্পিয়ান 'নে চা' নামে চলচ্চিত্রটি দেশে মোট ৫০০ কোটি ইউয়েন রেনমিনপি আয় করে এবং রানার্স-আপ 'দ্য ওয়াডারিং আর্থ' নামে চলচ্চিত্রটি ডোমেস্টিক বক্সঅফিসে ৪৬৭ কোটি ইউয়েন রেনমিনপি আয় করতে সক্ষম হয়। কিন্তু চীনে এসব দারুণ জনপ্রিয় ও প্রশংসনীয় চলচ্চিত্র উত্তর আমেরিকায় ভালো ফল পায় নি। 'দ্য ওয়াডারিং আর্থ' বিগত ৫ বছরে উত্তর আমেরিকায় প্রদর্শিত অন্যান্য সব চীনা চলচ্চিত্রের মধ্যে সবচেয়ে ভালো করলেও বক্সঅফিসে মাত্র ৫৮ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার আয় করে। যা সারা বিশ্ব থেকে এ চলচ্চিত্রের মোট আয়ের ০.৮ শতাংশ। উত্তর আমেরিকায় 'নে চা' নামের চলচ্চিত্রটি বক্সঅফিসে ৩৭ লাখ মার্কিন ডলার আয় করে। এই পরিমাণ সারা বিশ্বে বক্সঅফিসের আয়ের ০.৫ শতাংশ।

চীনা চলচ্চিত্রের প্রভাব প্রধানত চাইনিজ সার্কেলে সীমাবদ্ধ বলে এসব চলচ্চিত্র চীনা মানুষ অধ্যুষিত শহরগুলোতে প্রদর্শন করা হয় এবং প্রদর্শনের স্থান ছিল শতাধিক। তাই চীনের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র সহজেই উত্তর আমেরিকার চাইনিজ সার্কেলে বিনোদনের ঢেউ তুলতে পারে, তবে বক্সঅফিসে তার অবস্থা তেমন সন্তোষজনক হয় না।

আসলে উত্তর আমেরিকায় চলচ্চিত্র বাজারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক বেশি। ডিজনির নেতৃত্বে ৫টি বড় কোম্পানি প্রায়ই পুরো বাজার দখল করে থাকে। জনমত ও পেশাদার দিক পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শত বছরব্যাপী হলিউডের তুলনায় চিত্রনাট্য, শুটিং, পরিচালকের দক্ষতা এবং অভিনয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনের চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।

তা ছাড়া, যখন চীনা চলচ্চিত্র উত্তর আমেরিকায় প্রদর্শিত হয়, তখন প্রধানত চাইনিজ সাউন্ডট্র্যাক ও ইংরেজি সাবটাইটেলের মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়। এতে উপভোগের মানও কমে যায়। সিনেমা এসকাপিস্ট নামে যুক্তরাষ্ট্রের ফিল্ম সমালোচনা ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা কাও শু মিন বলেন, অনেক মার্কিন দর্শক বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র দেখতে পছন্দ করেন না। এর প্রধান কারণ হলো, তারা সাবটাইটালের মাধ্যমে চলচ্চিত্র উপভোগ করতে অভ্যস্ত না। চীনে খুব জনপ্রিয় কিছু চলচ্চিত্র বিদেশে তেমন ভালো করতে না পারার প্রধান কারণ হলো, বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে অভিন্ন স্বার্থজড়িত বিষয়ে যথেষ্টভাবে গবেষণা করা হয় নি।

আন্দ্রে মরগান নামে এক মার্কিন নির্মাতা আগে চীন ও যুক্তররাষ্ট্রের সহযোগিতায় বেশ কিছু চলচ্চিত্র নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আগে চীনা চলচ্চিত্র ব্যক্তিরা তাদের দৃষ্টি আন্তর্জাতিক বাজরে রাখতেন না এবং শুধুমাত্র চীনের ডোমেস্টিক বাজারের দিকে নজর রাখতেন। তবে চীনের চলচ্চিত্র শিল্পের শক্তিশালী ও ডোমেস্টিক বাজার সুসংহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা নিঃসন্দেহে ধাপে ধাপে নতুন বাজার খুঁজতে বের হবেন। তিনি মনে করেন, চীনা চলচ্চিত্রকে পশ্চিমা জগতে আরও বেশি সাফল্য অর্জন করতে হলে, একদিকে চলচ্চিত্রের বিষয় দিয়ে পশ্চিমা দর্শকদের মুগ্ধ করতে হবে, অন্যদিকে পশ্চিমা জগতে চীনা সংস্কৃতি সম্পর্কে বোঝাপড়া ও পরিচিতি বাড়াতে হবে।

শাংহাইয়ের পার্ল স্টুডিও এবং যুক্তরাষ্ট্রের ড্রিমওয়ার্কস অ্যানিমেশন ইনকর্পোরেশনের সহযোগিতায় নির্মিত 'অ্যাবোমিনাবল' চলচ্চিত্রটি গত বছর উত্তর আমেরিকার বক্সঅফিস ৬ কোটি মার্কিন ডলার আয় করেছে। সারা বিশ্বে এই চলচ্চিত্রের মোট আয় ১৭.৬ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এ চলচ্চিত্রের পরিচালক জিল কাল্টোন সিনহুয়া বার্তা সংস্থার সাংবাদিকদের বলেন, চীনের চলচ্চিত্র শিল্প বিস্ফোরণের মতো উন্নয়নের সময় পার করছে। হলিউডের সঙ্গে সহযোগিতাকারী চীনা চলচ্চিত্র ব্যক্তিদের চলচ্চিত্র নির্মাণের দক্ষতা বাড়বে বলে তিনি মনে করেন। চীনের চলচ্চিত্র শিল্পের ভবিষ্যত নিয়ে তিনি অনেক আশাবাদী।

সিনেমা এসকাপিস্ট ওয়েবসাইটের কো-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা ইউ লি দে বলেন, হলিউডের সঙ্গে চীনের যত বেশি সহযোগিতা হবে, হলিউড চলচ্চিত্রের শিল্পায়ন প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে চীনের চলচ্চিত্র মহলের জানাশোনা তত বাড়বে। ফলে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রযুক্তি বৃদ্ধি পাবে।

হুয়াসিয়া ফিল্ম ডিসট্রিবিউশন কর্পোরেশনের মহাপরিচালক সু চিয়া সিনহুয়া বার্তা সংস্থার সাংবাদিকদের বলেন, চীনের চলচ্চিত্র উত্তর আমেরিকার বাজারে স্থান করে নিয়েছে। স্থিতিশীলভাবে তা বড় হচ্ছে। কীভাবে চাইনিজ সার্কেল ছাড়িয়ে আরও বেশি স্থানীয় দর্শকদের কাছে যাওয়া যায়, চীনা চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজকদের সে বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া উচিত্।

সু চিয়া আরও বলেন, চীনা চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতির প্রতি পশ্চিমা দর্শকেরা খুব আগ্রহী। তবে কীভাবে সেই আগ্রহের জবাব দেওয়া যায়, তাই হলো বর্তমান সময়ের একটি চ্যালেঞ্জ। আগে পশ্চিমা দুনিয়ায় চীনের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ছিল কংফু-সংক্রান্ত চলচ্চিত্র। ব্রুস লি থেকে জ্যাকি চান তারাই হলেন পশ্চিমা দর্শকদের চোখে চীনা চলচ্চিত্রের বিজনেস কার্ড। নতুন যুগে চীনা চলচ্চিত্রের নতুন বিজনেস কার্ড সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য চীনা চলচ্চিত্র ব্যক্তিদের নিরলস প্রচেষ্টার প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।

(লিলি/তৌহিদ)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040