চলুন বেড়িয়ে আসি: জাপানের কিয়োটো থেকে
  2020-08-05 15:33:21  cri

জাপানের হংসু দ্বীপে অবস্থিত কিয়োটো ৭৯৪ থেকে ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত জাপানের রাজধানী শহর ও সম্রাটের বাসভবন হিসেবে পরিচিত ছিল।। প্রায় ১.৫ মিলিয়ন জনসংখ্যা নিয়ে গড়ে উঠা কিয়োটো জাপান এর প্রথম দশটি বৃহত্তম শহরের মধ্যে অন্যতম। বহু শতাব্দী ধরে নানা যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত এই শহর নিজস্ব ইতিহাস ও মূল্যবোধের জন্য বিশ্বের ইতিহাসে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছে। কিয়োটো-তে অবস্থিত বিভিন্ন মন্দির ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো পর্যটকদের এই শহর ভ্রমণের আগ্রহী করে তোলে।

জাপানের কিয়োটোর দর্শনীয় স্থান

কিয়োটো শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো মূলত কেন্দ্রীয় কিয়োটো, পুর্ব কিয়োটো, দক্ষিণ কিয়োটো ও উত্তর কিয়োটো অঞ্চলে বিভক্ত। তবে পুরো কিয়োটো শহর জুড়ে রয়েছে অসংখ্য মন্দির এবং মঠ, যার প্রতিটার সৌন্দর্য ভিন্ন ভিন্ন।

নিজো ক্যাসেল

১৬০৩ সালে নির্মিত নিজো ক্যাসেল প্রথমে জাপানের এক মিলেটারি ডিক্টেটরের বাসভবন ছিল। তার মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে তার নাতি ক্যাসেলটি কিছুটা সংস্কার করে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃত এই ক্যাসেল হনমারু, নিনোমারু এবং বাগানের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছে। নিনোমারু প্যালেস মিলিটারি ডিক্টেটরের কার্যালয় ও বাসভবন ছিল। যেখানে ভিন্ন ভিন্ন বিল্ডিংগুলো করিডোরের মাধ্যমে একটির সাথে আরেকটি সংযুক্ত।

আর হনমারু হল ৫ তালা বিশিষ্ট দ্বিতীয় কমপ্লেক্স, যা ১৮ শতকে আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এই প্যালেসকে বিশেষ বিশেষ দিনে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। পর্যটকরা হনমারু বাগানে নিরিবিলি সময় কাটানোর সাথে সাথে পাথরের ভিত্তি প্রস্তরের উপর উঠে চারপাশের সুন্দর ভিউ দেখতে পারবে। আর এই দুটি প্যালেসকে ঘিরে রেখেছে সবুজ বাগান যেখানে অসংখ্য চেরি ও পাম গাছ আছে।

কিয়োটো রেলওয়ে মিউজিয়াম

২০১৬ সালে উদ্বোধন হওয়া এই জাদুঘরটি ৩০,০০০ স্কোয়ার মিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। কিয়োটো স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটে মাত্র ২০ মিনিট সময় লাগে। রেলওয়ের প্ল্যাটফর্মের মতো তৈরি করা এই জাদুঘরে ৫৩টি অচল রেলওয়ে, প্রাচীন কালের বাস্প ইঞ্জিন চালিত রেল, আধুনিক যুগের ইলেকট্রিক ট্রেন ও বুলেট ট্রেন ইত্যাদি প্রদর্শন করে রাখা হয়েছে। এছাড়াও রেলওয়ের বিভিন্ন কল-কব্জা, ইউনিফর্মস সহ রেলওয়ের উপর প্রাচীন ও আধুনিক যুগের বিশেষ কিছু চিত্রশিল্প আছে।

কিয়োটো ইম্পেরিয়াল প্যালেস

কিয়োটো ইম্পেরিয়াল প্যালেস ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত জাপানের রাজকীয় পরিবারের আবাসস্থল ছিল। এখানে বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা আছে যার মধ্যে সেন্টো প্যালেস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

সেন্টো প্যালেস

কিয়োটো স্টেশন থেকে মাত্র ১০ মিনিট দূরত্বে কিয়োটো ইম্পেরিয়াল পার্কে অবস্থিত এই প্যালেস। সেন্টো প্যালেস ভ্রমণের ক্ষেত্রে ইম্পেরিয়াল হাউজহোল্ড এজেন্সির ট্যুরে অংশগ্রহন করতে হবে।

কিয়োটো মানগা মিউজিয়াম

২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে উদ্বোধন হওয়া ৩ তালা বিশিষ্ট এই জাদুঘর কিয়োটো শহরের একটি বিশেষ আকর্ষণ। মানগা মূলত জাপানি ভাষায় সৃষ্ট একটি কমিক বা গ্রাফিক্স নোবেল। জাদুঘরে আন্তর্জাতিক মানগা আর্টিস্টের বিভিন্ন কাজ, মানগা কমিকসের প্রচার ও ক্রমবর্ধমান বিকাশের নানা দিক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

কিয়োটো একুয়ারিয়াম

২০১২ সালের মার্চ মাসে উদ্বোধন হওয়া এই একুয়ারিয়াম উমেকজি পার্কে অবস্থিত। দুইতালা বিশিষ্ট একুয়ারিয়াম নয়টি ভাগে রয়েছে। কিয়াটো একুরিয়ামে বিশাল আকারের সালামান্ডার, পেঙ্গুইন, শীল ও বিরল প্রজাতির বিভিন্ন জলীয় প্রাণী দেখতে পারবেন। এখানে জনপ্রতি টিকেটের মূল্য ২০৫০ ইয়েন।

কিয়োটো টাওয়ার

১৩১ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট এই টাওয়ারটি কিয়োটোর সুউচ্চ টাওয়ার। আধুনিক আইকনিক ল্যান্ডমার্ক হিসেবে জনপ্রিয় এই টাওয়ারের ১০০ মিটার উচ্চতা থেকে ৩৬০ ডিগ্রি এঙ্গেলে কিয়োটো শহর দেখা যায়। আবার আকাশ পরিষ্কার থাকলে ওসাকা শহরও নজরে পড়ে। শপিং করার সাথে সাথে এই টাওয়ারে খাওয়ার জন্য বেশ ভালো মানের কিছু রেস্টুরেন্ট আছে। এখানে ঘুরতে হলে জনপ্রতি ৭৭০ ইয়েন খরচ করতে হবে।

কিয়োটো ন্যাশনাল মিউজিয়াম

জাপানের প্রাচীন জাদুঘরের মধ্যে কিয়োটো ন্যাশনাল মিউজিয়াম অন্যতম। চার তালা বিশিষ্ট এই জাদুঘরে জাপানের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। অস্থায়ী বিশেষ কিছু প্রদর্শনী প্রায়ই হয়ে থাকে। আর জাদুঘরের স্থায়ী প্রদর্শনী দেখতে ৫২০ ইয়েন খরচ হবে এবং বিশেষ প্রদর্শনী দেখতে লাগবে ১৫০০ ইয়েন। সকাল ৯ টা ৩০ মিনিট থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকে এই জাদুঘর।

আরাশিয়ামা

কিয়োটোর পশ্চিমাঞ্চলের একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্থান আরাশিয়ামা। নৌকা কিংবা বাই সাইকেল ভাড়া করে পুরো এলাকা ঘুরে বেড়াতে পারবেন। এখানে বেশ কিছু ছোট ছোট শপ, রেস্টুরেন্ট এবং মন্দির রয়েছে। এপ্রিলের শুরু ও নভেম্বরের শেষের দিকে চেরি ফুল ফুটলে এক অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশের সৃষ্টি হয় আরাশিয়ামাতে।

আর কিয়োটো শহরের মন্দির ও মঠের মধ্যে কিয়ুমিযুডেরা (Kiyomizudera, কাঠের টেরাসের জন্য এই মন্দির পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়), তজি টেম্পল (Toji Temple, জাপানের সবচেয়ে বড় প্যাগোডা অবস্থিত এই মন্দিরে), দাইগোজি টেম্পল (Daigoji Temple, কিয়োটোর দক্ষিণ পূর্বের বিখ্যাত মন্দির ), টফুকুজি টেম্পলে (Tofukuji Temple, মন্দিরের চারপাশে শরৎ পাতা দিয়ে ঘেরা সুন্দর প্রকৃতি), কিনাকাকুজি (Kinkakuji, সোনালি মন্দির), হঙ্গাঞ্জি টেম্পল (Honganji Temple), গিনকাকুজি (Ginkakuji), নেনযেজি টেম্পল (Nenzeji Temple), ফুশিমি ইনারি শিরিন (Fushimi Inari Shirine), ওয়াসাকা শিরিন (Yasaka Shrine) উল্লেখযোগ্য।

কিভাবে যাবেন কিয়োটো শহরে

টোকিও শহর থেকে ৪৫০ কিলো দূরে অবস্থিত কিয়োটো শহরে হিকারি বা নযোমি বুলেট ট্রেনে যাওয়া যাবে। টোকিও ষ্টেশন থেকে ২ ঘণ্টা ২০ মিনিট সময় লাগে কিয়োটো স্টেশন পৌঁছাতে।

কোথায় থাকবেন

কিয়োটো শহরের মধ্যে গিয়ন শহর, কিয়োটো ষ্টেশন ও কিনকাকু-জি টেম্পলের আসে পাশে থাকার জন্য বেশ কিছু ভালো মানের হোটেল, গেস্ট হাউজ ও হোস্টেল আছে। কিয়োটো তসুকিউসাগি গেস্ট হাউজ, ডাউন টাউন ইন কিয়োটো, মাছিয়া ওযারা, সান্তিয়াগো গেস্টহাউজ কিয়োটো, টোমাটো গেস্ট হাউজ, সামুরাই হোম শিজ ওমিয়া, গ্র্যান্ড রেম কিয়োটো, শিওরি-এন, দা ওয়েস্টার্ন হোটেল কিয়োটোর মতো হোটেল ও গেস্ট হাউজে দুইজনের থাকতে খরচ হবে ১৪০০ থেকে ২১০০ টাকা পর্যন্ত।

কিয়োটো শহরে স্থানীয় খাবারের জন্য কিটছো, শুশিসেই, কারাকো, ওরাই, গ্রাঙ্কো সুশি, ফালাফেল গারদেন,তস্কা, তোগাডেন এর মতো রেস্টুরেন্টগুলো বেশ ভালো। আর জাপানের কাইসেকি কুজিন, সুশি, রামেন, শোকুডু, ওকোনোমিয়াকি, ইয়াকিতরি ও টফুর ইত্যাদি খাবারের জন্য কিয়োটো শহর বিশেষ ভাবে প্রসিদ্ধ।

কিয়োটো শহরের দ্যা কিয়োটো হ্যান্ডি ক্রাফটস সেন্টার, নিশিকি মার্কেট, কবো সান ফ্লেয়া মার্কেট, কামিজি কাকিমোতো, ইপ্পোডো, বিক ক্যামেরা, রবার্ট ম্যানগোল্ড গ্যালারি, কিয়োটো আর্ট এন্ড এন্টিক এর মতো শপ গুলোতে কেনার মতো অনেক কিছু খুঁজে পাবেন। আর কিয়োটো শহর থেকে ইলেক্ট্রনিকস, সিরামিক্স, গ্রিন টি, ঐতিহ্যবাহী পোশাক কিমোনো, এন্টিকের বিভিন্ন জিনিস ও গহনা, কাঠের শো পিস, হ্যান্ডি ক্র্যাফটস আইটেম ও সুভেনিয়র কিনতে পারেন।

কিয়োটো ভ্রমণে কিছু টিপস

অক্টোবর থেকে নভেম্বর এবং মার্চ থেকে মে মাস জাপানের কিয়োটো ভ্রমণের জন্য ভালো সময়।

৭ দিনের জাপান রেল পাস করে নিলে বুলেট ট্রেনে যাতায়াতে খরচ কম হবে।

কিয়োটো শহরে বেশ কিছু স্থাপনা কোন খরচ ছাড়াই ঘুরে দেখতে পারবেন।

গুগল ম্যাপে কিয়োটোর বিভিন্ন পর্যটন স্পট দেখে নিলে কাছাকাছি অবস্থিত জায়গা গুলো হেঁটে দেখা যাবে।

কিয়োটো ষ্টেশনের কাছাকাছি কোন হোটেল ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করবেন কারণ অধিকাংশ পর্যটন স্থান এই ষ্টেশন থেকে কাছাকাছি দূরত্বে অবস্থিত।

কিয়োটো শহরে ৫ ইয়েন-কে গুড লাক হিসেবে বিবেচনা করা হয় আর মন্দির ও মঠ গুলোর প্রার্থনা বক্সে সাধারনত কিছু দান করতে হয় তাই সাথে বেশ কিছু ৫ ইয়েন রাখলে সুবিধা হবে। (রুবি/তৌহিদ)

 

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040