লি জি ছি: গ্রামে স্বপ্ন সৃষ্টিকারী মেয়ে
  2020-09-06 15:33:06  cri

চীনা ইউটিউব সেলিব্রেটি লি জি ছি। ইউটিউবে লি জি ছি'র জীবন দেখলে মনে হবে, এটা আমাদের এই পৃথিবী নয়, অন্য কোনো রূপকথার দেশ। চীনের সিছুয়ান প্রদেশের মিয়ান ইং শহরের একটি গ্রামের মেয়ে লি জি ছি। নিজের প্রতিদিনের জীবন ভিডিও করে ইউটিউবে আপলোড করেন তিনি। একাই শুরু করেছিলেন সব কিছু। নিজেই ক্যামেরা বসিয়ে নিজের প্রতিটি কাজ ভিডিও করেন। পুরো প্রক্রিয়াটির ভিডিও নিজেই সম্পাদনা করে ইউটিউবে দিতে থাকেন। তাতেই চারিদিকে সাড়া পড়ে যায়। তারপর বেশ কয়েক বছর ধরে প্রকৃত লি জি ছি'র কথা কিছুই জানা যায় নি।

অনেকেই সন্দেহ করেন এক একা এত ভালো মানের ভিডিও করা কীভাবে সম্ভব? তবে লি জিছি শুরুতে একাই শুরু করলেও এখন একজন ক্যামেরাম্যান ও অ্যাসিসটেন্টের সাহায্য নেন। চীনা অনলাইন ভিডিওর বাজার প্রায় ৬৫০ কোটি ডলারের। তার একটা অংশ ইউটিউব সেলেব্রিটি লি জি ছির কাছে তো যাচ্ছেই।

লি জি ছি সাধারণ জীবনের একজন স্বপ্ন তৈরিকারী, তিনি সত্যি স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করা একজন সাধারণ মানুষ। পাহাড় ও গ্রামে, বসন্তের বাতাস ও শরত্কালের ফলনে, তিনি চীনাদের ঐতিহ্য ও সরল জীবনযাপনের পদ্ধতি তুলে ধরেছেন। আধুনিক শহরবাসীরা তাঁর ভিডিও'র মাধ্যমে মনে অনেক সান্ত্বনা পেয়েছেন। সারা বিশ্ব একটি জীবিত চীনা সংস্কৃতি সম্বন্ধে উপলব্ধি করতে পেরেছে। তিনি প্রতিদিনের প্রতি খাবার ও মিল দিয়ে ঋতু পরিবর্তন ও সময় পার হওয়ার সুন্দর দৃশ্য তুলে ধরেছেন। তাঁর ভিডিও'র মাধ্যমে সবাই দেখেছে যে, 'শ্রম' জীবনকে কত প্রাণচঞ্চল করতে পারে।

লি জি ছি গত কয়েক বছর ধরে তাঁর ভিডিওতে কাব্যিক আমেজে গ্রামীণ জীবন তুলে ধরেছেন। সিছুয়ান প্রদেশের মিয়ান ইং-এর গ্রামে, তিনি সাদামাটা কাপড় পরে বিভিন্ন ধরনের খাবার রান্না করেন, ফল তোলেন ও মাছ ধরেন।

চীনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ওয়েইপো হোক, ইউটিউব হোক, তাঁর বিপুল পরিমাণ ভক্ত রয়েছে। কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করে, হঠাত্ সবার দৃষ্টিতে চলে আসায় কেউ তাঁর বিখ্যাত হওয়ার উত্স জিজ্ঞেস করে। লি জি ছি হাসি মুখে বলেন, সবাইকে ধন্যবাদ। অর্থাত্, দর্শকরা তাঁকে পছন্দ করুক বা না-করুক তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানান।

তিনি বলেন, এই বিশ্বের প্রতিটি মানুষ তাকে উপলব্ধি করবে- এটা অসম্ভব ব্যাপার। কেউ বিখ্যাত হলে, নিশ্চয়ই ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। তাই যদি কেউ তাঁকে পছন্দ করে, সেজন্য তিনি খুব কৃতজ্ঞ।

লি জি ছি নিজের উঠানে বসে বলেন, যে কোনো ধরনের জীবনের ভালো দিক আছে, মন্দ দিকও আছে। শহরে যেমন অনেক ধনী মানুষ আছে, তেমনি এমন মানুষও আছে, যারা প্রতিদিন অনেক কাজ করে। শিশুর লেখাপড়ার ফি যোগাড় করার জন্য নিজে ভালো খাবার খান না। আসলে গ্রামেও এমন। চলতি বছর চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি চালু হওয়ার ৪২ বছর পূর্তি, গ্রামের সবাই কি গরীব হয়? চীনের গ্রাম কি সুন্দর ও সমৃদ্ধ হতে পারে না?

তাঁর উঠানে একটি পাথরের টেবিল আছে, টেবিলে চা-এর কাপ রয়েছে। চারপাশেই রঙিন ফুল ও ফল দেখা যায়। তাঁর দাদি ছোট কুকুর কোলে নিয়ে সূর্যের আলোয় বসতে পছন্দ করেন।

তিনি সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর ভিডিও তোলার সঙ্গে সঙ্গে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। যেমন, গ্রীষ্মমণ্ডলের প্যাশন ফ্রুট, আনারস ও ড্রাগন ফ্রুট সিছুয়ানের গ্রামে চাষ করতে চান তিনি। তবে সেখানকার আবহাওয়া ও জমি ততটা উপযোগী নয়। তাই লি জি ছি এসব ফল গ্রিনহাউসে চাষ করেন। দ্বিতীয় বছর স্বাভাবিকভাবে ফল পাওয়া যায়। শীতকালে স্ট্রবেরি চাষ করা আরো জটিল ব্যাপার। টেকসইভাবে আগুনের গামলা দিয়ে হিট তৈরি করতে হয়। লি জি ছি স্বীকার করেন, গ্রামীণ জীবন নিয়ে শুটিং করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। মাঝে মাঝে বৃষ্টির দিনে ক্ষেতে কাজ করতে করতে পুরো শরীর নোংরা হয়ে যায়। একবার মিয়ান ইয়াং শহরে ১৫ দিন ধরে টানা বৃষ্টি পড়ে। উঠানের সব গাছ পানিতে ডুবে যায়। তিনি বাধ্য হয়ে পুনরায় সব চারা আবারও চাষ করেন। একবার চীনের লানচৌ শহরের হালাল খাবার—গরুর মাংসের নুডলসের ভিডিও তৈরির জন্য তিনি বিশেষভাবে লান চৌ শহরে গিয়ে রান্নার পদ্ধতি শিখে আসেন।

ফলোয়ারদের মূল্যায়ন দেখে, কেউ তাঁর প্রশংসা করে বলে যে, লি জি ছি যেন পরীর মতো। তিনি এমন মূল্যায়ন পছন্দ করেন। তবে তিনি আরো ভাবেন, বাস্তব জীবনে তিনি সবসময় ক্ষেতেই কাজ করেন, শরীরে সবসময় কাদা-মাটি লেগে থাকে, পরীর মত নয়!

সবার অতীতের গল্প আছে, পরীরও

ছোটবেলায় লি জি ছি'র বাবা মা'র বিবাহবিচ্ছেদ হয়। তারপর তাঁর বাবা অনেক আগেই মারা যান। তিনি আগে একবার বলেছিলেন যে, তাঁর সৎ মা তাঁর চুল ধরে পানিতে তার মাথা চেপে ধরেছিল, তাঁকে খুব মেরেছিল। তাঁর দাদা দাদি তা দেখে খুব কষ্ট হয়েছিল এবং তাঁকে নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে গেছেন। তাঁর দাদা বাবুর্চি ছিলেন, গ্রামের সব কাজ করতে পারতেন। লি জি ছি এভাবে গ্রামের অনেক কাজকর্ম শিখে ফেলেন। তাঁর ভিডিওতে যে মুনকেক ও বাঁশের সোফা বানানো দেখা যায়, সবই তাঁর দাদার কাছ থেকে শেখা। দাদা মারা যাবার সময় লি জিছি প্রাথমিক স্কুলে পড়তেন। দাদি তাঁকে ১৪ বছর পর্যন্ত লালন-পালন করেছিলেন। তারপর আর তাঁর যত্ন নিতে পারতেন না। এরপর লি জি ছি জীবনযাপনের জন্য শহরে আট বছর ধরে কাজ করেছিলেন। তিনি পার্কের চেয়ারে শুয়ে থাকতেন, দুই মাস ধরে শুধু রুটি খেতেন। যখন তিনি রেস্তরাঁর সেবক ছিলেন, তখন তাঁর মাসিক বেতন ছিল মাত্র ৩ শ' ইউয়ান।

পরে তিনি একজন শিল্পীর কাছ থেকে সঙ্গীত শিখেন। তিনি পানশালায় একটি চাকরি খুঁজে পান। লি জি ছি এই কাজ শুধু একটি কারণে করতেন; তা হলো দাদির জন্য কিছু অর্থ উপার্জন করা, যাতে দাদিকে খুশি করা যায়। ২০১২ সালে দাদি একবার অসুস্থ হন, অন্যের সাহায্য ও যত্নের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তাই লি জি ছি গ্রামে ফিরে যান। তখন তাঁর ছোট ভাই নিজের গিটার বাজানোর ভিডিও ওয়েবসাইটে পোস্ট করেন, ছোট ভাই লি জি ছিকে এভাবে ভিডিও করার প্রস্তাব দেন। তখন লি জি ছি ভাবতেন, তিনি যে কাজ সবচেয়ে ভালো করতে পারেন, তা হল রান্না করা। তাই তিনি ওয়েবসাইটে নিজের রান্না করার ভিডিও পোস্ট করতে শুরু করেন।

এখন লি জি ছি'র ইউটিউব অ্যাকাউন্টে শতাধিক ভিডিও আপলোড করা হয়েছে; ফলোয়ারের সংখ্যা ৭৫ লাখেরও বেশি। লি জি ছি বিদেশি বন্ধুর কমেন্টস দেখতে পছন্দ করেন। কেউ লিখেছে, চীন খুব সুন্দর একটি দেশ, অস্ট্রেলিয়ায় শুধু মরুভূমি দেখা যায়।

লি জি ছি আগে গণমাধ্যমে বলেছিলেন যে, তিনি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি সম্পর্কে খুব আগ্রহী। এখন ভিডিও তৈরির সঙ্গে সঙ্গে তিনি সংস্কৃতির ক্লাসও করছেন।

ইন্টারনেটে তাঁর বিখ্যাত হওয়া চার বছর আগের কথা। ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে, তাঁর 'লান চৌ শহরের গরুর মাংসের নুডলস' ভিডিওটি দেখা হয় ৫ কোটি বার! লাইক পড়ে ৬ লাখেরও বেশি!

২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে, লি জি ছি'র তৈরি করা দোলনার ভিডিওতে এক কোটি ক্লিক হয়। প্রচার হয় ৮ কোটি বার। তাতে ১০ লাখ লাইক পড়ে। প্রতিদিন অনেক কোম্পানি তাঁর ভিডিওতে বিজ্ঞাপন প্রচারের আগ্রহ জানায়।

এমন সময় লি জি ছি'র কিছু সাহায্য দরকার ছিল। ২০১৭ সালের ২০ জুলাই লি জি ছি হাং চৌ-এর এক কোম্পানির সঙ্গে সিছুয়ান লি জি ছি সংস্কৃতি ও প্রচার কোম্পানি গড়ে তোলেন।

২০১৮ সালের ১৭ অগাস্ট, লি জি ছি চীনের বৃহত্তম অনলাইন কেনাকাটা প্ল্যাটফর্ম থাওপাও-তে নিজের দোকান খোলেন। এই দোকানে তাঁর তৈরি করা পাঁচ ধরনের খাবার বিক্রি করা হয়। এসব খাবার অনলাইনে ৬ দিনের মধ্যে আয় করে ১.৫ লাখ ইউয়ানের বেশি!

লি জি ছি বলেন, ব্র্যান্ড তৈরি করা আমার একটি স্বপ্ন। আমি ভালোভাবে এ কাজ করতে চাই। আমার ব্র্যান্ডের চিন্তাধারা হল-ধীর গতির জীবন, নতুন ঐতিহ্য। তিনি মনে করেন, বর্তমানে শহরের মানুষের চাপ অনেক বেশি। সবাই জীবন, পরিবার ও বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ভিডিওতে আরামদায়ক ও সুন্দর দৃশ্য দেখালে দর্শকের মনের উদ্বেগ কমে যায়, মন শান্ত হয়।

লি জি ছি বলেন, তাঁর পছন্দের জীবন ঠিক তাঁর ভিডিও'র মত, চিন্তামুক্ত, নিজের জন্য যা দরকার, তা নিজেই তৈরি করতে পারেন। বাড়ির উঠানে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি আছে, প্রতিদিন ভোরে ক্ষেতে গিয়ে সারা দিনের জন্য ফল ও শাকসবজি তুলে আনেন, তারপর কিছু সুন্দর ফুল দিয়ে ঘর সাজান। সূর্য ওঠার পর আর বাইরে যান না, বাসায় পুরো দিন থাকেন, সুস্বাদ খাবার রান্না করেন, হস্তশিল্পের কাজ করেন, টিভি দেখেন....এভাবেই প্রতিদিন সুন্দর জীবন কাটানোর চেষ্টা করেন।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040