স্মরণীয় বরণীয় যারা: শিক্ষক ওয়াং পাহাড়ের বীর
  2020-10-09 15:33:55  cri

চীনের হ্যপেই প্রদেশের সা হ্য শহরের হুয়া মু গ্রাম থাই হাং পর্বতের মাঝখানে অবস্থিত। গ্রামে একটি ফলের বাগান আছে। সেই বাগান থেকে শোনা যাচ্ছে শিশুদের উচ্চস্বরে বই পড়ার আওয়াজ।

যিনি শিশুদের পড়াচ্ছেন, তিনি হলেন স্থানীয় শিক্ষক ওয়াং জি লিন। তাঁর ছয় জন শিক্ষার্থী। এই হল- হুয়া মু গ্রামের বিদ্যালয়! ৫৮ বছর বয়সী শিক্ষক ওয়াং জি লিন ১৯৮১ সাল থেকে এই গ্রামে শিক্ষাদান শুরু করেন।

শিক্ষক ওয়াং বলেন, শিশুরা আমাকে ছাড়া খুশি হয় না, আমিও তাদেরকে ছাড়া খুশি থাকতে পারি না। এটাই হল আমাদের সম্পর্ক। এই গ্রাম শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। শহর থেকে দূরে পাহাড়ের গভীরে এই গ্রামে যেতে দুই ঘণ্টা সময় গাড়ি চালাতে হয়। এ অবস্থায় শিক্ষক ওয়াং ৩৯ বছর ধরে এখানে কাজ করে যাচ্ছেন।

হাঁড়ি থেকে পানির বাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে সারা ঘরে। ছোট কার্যালয়ে, শিক্ষক ওয়াং দুই ক্লাসের মধ্যে বিশ্রামের সময় ছয়টি শিশুর জন্য পুষ্টিকর খাবার তৈরি করেছেন, সিদ্ধ ডিম ও দুধ- এই হল প্রতিটি শিশুর খাবার।

মাত্র ১৫ বর্গমিটারের ছোট ঘর ওয়াং-এর কার্যালয়, তাঁর রান্নাঘরও বটে। জরাজীর্ণ একটি কেবিনেট দিয়ে ঘরটিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর পিছনে হল একটি পুরানো কাঠের বিছানা, বিছানার সব রং হারিয়ে গেছে। পাহাড়ের আবহাওয়া সবসময় পরিবর্তন হয় এবং মাঝে মাঝে খুব খারাপও হয়। যখন খারাপ আবহাওয়া দেখা দেয় তখন শিক্ষক ওয়াং রাতে এখানেই বিশ্রাম নেন।

ওয়াং হল স্থানীয় মানুষ। ২০ শতাব্দীর ৬০ ও ৭০ দশকে, তাঁর বাবাও একজন শিক্ষক ছিলেন। তখন গ্রামে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা খুব কম ছিল। উত্পাদক দল সবার জন্য জমি বিতরণ করার সময় ওয়াং-এর বাবার কাছে সাহায্য চেয়েছিল। ওয়াং বলেন, সেসময় তাঁর বাবা তাঁর মনে শিক্ষকতার চারা রোপণ করেছিলেন।

১৯ বছর বয়সে, ওয়াং স্থানীয় চাই গৌ প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। প্রায় ৪০ বছর শিক্ষকতার জীবনে, তিনি যথাক্রমে চারটি স্কুলে কাজ করেছেন। শিক্ষাদানের স্থান পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু একটি বিষয় পরিবর্তন হয় নি; দুর্গম পথ ও বিপজ্জনক প্রাকৃতিক পরিবেশ! দীর্ঘ চার দশকে দুর্গম পথ পাড়ি দিতে গিয়ে শিক্ষক ওয়াং-এর এক শতাধিক জুতো নষ্ট হয়েছে।

সাংবাদিক তাঁর সাক্ষাত্কার নেবে— এ কথা শুনে শিক্ষক ওয়াং বিছানার নিচ থেকে কয়েক বছর আগে কেনা এক জোড়া নতুন জুতো বের করে পরেন। তিনি এর আগে কখনই নতুন জুতা পরতে চাইতেন না।

তবে শিশুদের জন্য তিনি খুব উদার। ভালোভাবে গণিত শেখানোর জন্য ওয়াং সারা দিন ধরে পাহাড়ি পথ পার হয়ে থানার মেলা থেকে ৫ ইউয়ান দিয়ে একটি 'গণিতবিদ্যা অভিধান' কিনে আনেন। তখন তাঁর মাসিক বেতন ছিল মাত্র চার ইউয়ান। ক্লাসে একটি শিশুর পারিবারিক অবস্থা খুব খারাপ। একটি নতুন পেন্সিল বা কলম কেনার টাকাও ছিল না। শিক্ষক ওয়াং দ্বিধা না করে নিজের ১ ইউয়ান মূল্যের নতুন কলম বাচ্চাটিকে দিয়ে দেন।

চলতি বছর করোনাভাইরাসের মহামারি দেখা দেয়। এমন বিশেষ সময়, শিশুদের অনলাইন ক্লাস দেয়ার জন্য শিক্ষক ওয়াং অবশেষে নিজের খুব পুরানো মোবাইলফোন পরিবর্তন করেন এবং ১ হাজার ইউয়ান দিয়ে একটি স্মার্ট ফোন কিনেন। এটাই হল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিজের জন্য কেনা সবচেয়ে দামি জিনিস।

শরত্কালে আবারও স্কুল খুলেছে। শিক্ষক ওয়াং খুব খুশি হয়েছেন। কারণ, তিনি আবারও সরাসরি শিশুদের ক্লাস নিতে পারবেন। যখন তিনি প্রথম শ্রেণীর শিশুদের ক্লাস নেন, তখন দ্বিতীয় শ্রেণীর শিশুরা চীনা অক্ষর লেখার চর্চা করে, তারপর তিনি আবার দ্বিতীয় শ্রেণীর শিশুদের ক্লাসের পাঠদান করেন।

এভাবে ক্লাস নিতে শিক্ষক ওয়াংকে অনেক সময় নিয়ে প্রস্তুতি নিতে হয়। শিশুর সংখ্যা বেশি না হলেও, তবে কোর্সের বিষয় কিন্তু বেশি। শিক্ষক ওয়াং একাই দুই শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের চীনা ভাষা, গণিতবিদ্যা, ক্রীড়া ও সংগীত— সব বিষয় শেখান।

হুয়ামু শিক্ষাদান স্থানের ভাঁড়ার ঘরের কোণায় একটি পুরানো চেয়ার আছে; সেখানকার সাবেক শিক্ষক এই চেয়ারটি রেখে গেছেন। চেয়ারটি শিক্ষক ওয়াং-এর ১৪ বছরের সঙ্গী। ওয়াং বলেন, এই চেয়ার ছাড়তে চাই না, এই চেয়ার দেখলে আগের স্মৃতি মনের পর্দায় ভেসে ওঠে।

১৯৮৬ সালে তিনটি শিক্ষাদান এলাকার শতাধিক শিক্ষকের শিক্ষাদান প্রতিযোগিতায় শিক্ষক ওয়াং-এর গণিতবিদ্যা ক্লাস প্রথম পুরস্কার পেয়েছে। শহরের অনেক স্কুল শিক্ষক ওয়াংকে নিজের স্কুলে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সেসব স্কুলের বেতনও অনেক ভালো।

তবে শিক্ষক ওয়াং তাদেরকে 'না' বলে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ভালো পরিবেশ ও উন্নত স্থানের চেয়ে পাহাড়ি এলাকার শিশুদের আমাকে বেশি প্রয়োজন। আমি চলে গেলে তাদের কোনো শিক্ষক থাকবে না।

৪০ বছরে শিক্ষক ওয়াং-এর দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল থেকে বের হওয়ার অনেক সুযোগ তৈরি হয়। তিনি কখনও এমন কথা ভেবেছিলেন। কয়েকবার তিনি প্রায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন।

২০ শতাব্দীর ৮০ দশকের শেষে, শিক্ষক ওয়াং-এর প্রতিবেশী পরিবার প্রতিদিন শাকসবজি বিক্রি করে ১৫ ইউয়ান উপার্জন করে। যা শিক্ষক ওয়াং-এর পুরো মাসের আয়ের অর্ধেক! ওয়াং বলেন, তখন আমার বেতন খুব কম ছিল, আমার দুই ছেলেমেয়ে আছে, তাদের বড় করতে অনেক টাকার প্রয়োজন। অথচ, তখন আমার পরিবার এত গরিব ছিল যে, তেল কেনার টাকাও জুটত না!

তবে প্রতিবার পাহাড়ি শিশু শিক্ষার্থীদের কথা এবং তার প্রতি তাদের বাবা-মার আস্থার কথা ভেবে, ওয়াং তাদের ছেড়ে চলে যেতে পারেন নি। এত বছরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সবচেয়ে লম্বা বিদায়টি হল- একবার তিনি পাহাড়ের বাইরে গিয়ে তিন মাসের একটি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

ওয়াং বলেন, তখন আমি খুব দ্বিধায় ছিলাম। একদিকে, বাইরে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে পাহাড়ি শিশুদের ভালোভাবে শিক্ষাদানের চিন্তা করতাম; অন্যদিকে, প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য শহরে থাকার সময় পাহাড়ি শিশুদের খুব মিস করতাম।

শিক্ষক ওয়াং শিশুদের সঙ্গে বন্ধুর মতো সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। তিনি শিশুদেরকে জ্ঞান দান করেন, শিশুদের বেড়ে ওঠায় সাহায্য করেন। আর শিশুরাও তাঁকে অনেক আনন্দ দেয়। তিনি বলেন, প্রতিবার শিশুদের মুখের নির্মল হাসি দেখে আমি ভাবি, আমার সিদ্ধান্ত শতভাগ ঠিক, তাদের হাসি-আনন্দ আমাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনেক শক্তি যুগিয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন সরকার শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অনেক বাড়িয়েছে। এর ফলে গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। আগে শিক্ষক ওয়াং যেখানে শিক্ষাদান করতেন, সেটি ছিল পাথরের তৈরি খুব জরাজীর্ণ স্থান; আর এখন সেটি দু'তলার ভবনে পরিণত হয়েছে।

শিক্ষাদানের নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো পদ্ধতি আর ব্যবহার করা হয় না। ইন্টারনেটে শিক্ষাদানের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য শিক্ষক ওয়াংকে অনেক কঠিনতা অতিক্রম করতে হয়েছে।

তিনি বলেন, এখন মাল্টিমিডিয়ার শিক্ষাদান ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়। আমি পিছনে পড়ে থাকতে চাই না। যে বিষয় আমি বুঝতে পারি না, সে বিষয়টি আমি তরুণ প্রজন্মের কাছ থেকে শিখে নেই, সক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশ নেই। ওয়াং বলেন, আধুনিক শিক্ষাদান ব্যবস্থার মাধ্যমে শিশুরা বাইরের রঙিন বিশ্ব সম্পর্কে জানতে পেরেছে, পাহাড়ি শিশুদের মধ্যে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন প্রজ্বলিত হয়েছে।

৩৯ বছর ধরে পাহাড়ি এলাকায় শিক্ষাদানের কাজ করার কারণে শিক্ষক ওয়াং অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি বেশ কয়েক বার সা হ্য শহরের 'শ্রেষ্ঠ শিক্ষক' ও 'শ্রেষ্ঠ কর্মীর' পুরস্কার পান।

সা হ্য শহরের দ্বিতীয় মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান জু চিয়ান সিয়াং হলেন শিক্ষক ওয়াং-এর প্রথম দফার ছাত্র। জু-এর চোখে, শিক্ষক ওয়াং তাঁর জীবন পথের দীক্ষাদাতা। তিনি বলেন, পাহাড়ি এলাকার পরিবেশ খুব কঠিন, তবে আমাদের শিক্ষক ওয়াং ৩৯ বছর ধরে ভালোভাবে সে কাজ করে যাচ্ছেন। আশেপাশের কৃষকরাও ওয়াংকে খুব সম্মান করে, তখন আমার মনে হয় শিক্ষকতার এই পেশা খুব মহান।

সা হ্য শহরে পাহাড়ি এলাকায়, শিক্ষক ওয়াং-এর মতো আরো অনেক শিক্ষক আছেন। সা হ্য শহরের শিক্ষা ব্যুরোর প্রধান জু রু সেন জানান, বর্তমানে এই শহরের পাহাড়ি এলাকায় ১০২টি স্থানে শিক্ষাদান করা হয়। এসব স্থানে শিক্ষকের সংখ্যা চার শতাধিক! মানুষ বলে, তারা হলেন থাই হাং পাহাড়ের গভীরে কাজ করা প্রকৃত বীর!

আর মাত্র দুই বছর পর শিক্ষক ওয়াং অবসরে যাবেন। তিনি বলেন, অবসরে গেলেও তিনি শিক্ষকতার কাজ করতে চান। দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের শিশুদের আমাকে প্রয়োজন আছে। যদি শুধু একটি শিশুও থাকে তাহলে আমি তাকে শিক্ষা দিতে চাই।

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040