চীনের চলচ্চিত্র বাজারের সর্বোচ্চ অবস্থা
2021-04-21 15:06:14

চীনের চলচ্চিত্র বাজারের সর্বোচ্চ অবস্থা_fororder_dianying

২০২১ সালের শুরুতে চীনের চলচ্চিত্র বাজারে টানা রেকর্ড ভেঙ্গেছে।

পহেলা জানুয়ারি ছুটির সময় প্রদর্শিত চলচ্চিত্রগুলোর বক্সঅফিসের মোট আয় ১৩০.২ কোটি ইউয়ান রেনমিনপি এবং এই সংখ্যা একই সময় ইতিহাসের সবচে ভালো ফলাফলের চেয়ে ২.৫ শতাংশ বেশি।

 

ফেব্রুয়ারি মাসে বসন্ত উত্সবের ছুটির সময় প্রদর্শিত চলচ্চিত্রগুলোর বক্সঅফিসের মোট আয় ৭৮৪.৩ কোটি ইউয়ান রেনমিনপিতে উন্নীত হয়; যা বিগত বছরের একই সময় তুলনায় ৩২.৮ শতাংশ বেশি।

এপ্রিল মাসে ছিং মিং ফেস্টিভালের ছুটিতে প্রদর্শিত চলচ্চিত্রগুলোর বক্সঅফিসের আয় ৮২ কোটি ইউয়ান রেনমিনপিতে উন্নীত হয়; যা ইতিহাসের সবচে বেশি অগ্রগতি। তা বিগত বছরের তুলনায় ১৭.৫ শতাংশ বেড়েছে।

 

টানা তিনটি সরকারি ছুটির সময় বক্সঅফিসের মোট আয় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সাফল্য সৃষ্টি করেছে। তবে ২০১৯ সালের বক্সঅফিসের তুলনায় ২০২১ সালের কিছুটা ব্যবধানও দেখা যাচ্ছে। ২০২১ সালে বক্সঅফিসের বার্ষিক আয় ৬০ বিলিয়ন ইউয়ান ছাড়িয়ে যাওয়া খুব কঠিন হবে না। তবে ৬৪.২ বিলিয়ন ইউয়ানের সীমা ছাড়িয়ে যেতে আরো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

 

চলতি বছর চীনের মুলভূভাগের চলচ্চিত্র বাজার নিঃসন্দেহে বিশ্বের প্রথম স্থানে থাকবে। উত্তর আমেরিকায় স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো বেশ পরিপক্ব হয়ে উঠছে। তারা গোটা দুনিয়ার চলচ্চিত্রের বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। ফলে বিশ্বের শীর্ষ চলচ্চিত্র বাজার হিসেবে চীনের এই অবস্থা ভবিষ্যতেও দীর্ঘ সময় ধরে চলবে।

 

তবে একটি বাজারের অসীম সম্প্রসারণ সম্ভব নয়। বাণিজ্যিক খাতে প্রত্যেকের একটি নির্দিষ্ট সীমানা রয়েছে। তাহলে চীনের প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত চলচ্চিত্র বাজারের সর্বোচ্চ সীমা কোথায়?

ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের উন্নত দেশগুলোর বাজারের তুলনা করলে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুলভূভাগের চলচ্চিত্র বাজারের উন্নয়নের অবস্থা এখন বিশ্লেষণ করব।

 

প্রথমে আমাদের এমন একটি বিষয় স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে, বাজারের সিলিংয়ের কথা বলতে গেলে আমরা প্রধানত চলচ্চিত্র উপভোগ করা দর্শকদের সংখ্যার সর্বোচ্চ সীমার কথা বুঝে থাকি। ভোক্তা মূল্য সূচক বা সিপিআই বা চলচ্চিত্র টিকিটের গড় দাম, যাই হোক না কেন, প্রতি বছর স্বাভাবিক এক হারে বাড়ছে। মুদ্রাস্ফীতিসহ নানা উপাদান বিবেচনা করে প্রতি যুগের অর্থনীতির মানও ভিন্ন হতে থাকে। তাই বক্সঅফিসের মানদণ্ড বিবেচনা করা অবশ্যই বাস্তবসম্মত নয়। সেই তুলনায় চলচ্চিত্র উপভোগ করা দর্শকদের সংখ্যাকে মানদণ্ড হিসেবে নির্ধারণ করলে আরো সরাসরি যে কোনো একটি চলচ্চিত্রের উন্মুক্তকরণ বোঝানো যাবে।

 

২০১৯ সালে চীনের মুলভূভাগের বক্সঅফিসের আয় কিছুটা বাড়লেও দর্শকদের সংখ্যা মাত্র এক শতাংশ বাড়ে। যা গোটা মহলের কাছে বিপদের ঘণ্টা বাজায়। দর্শকদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় গোটা চলচ্চিত্র খাতের বর্তমান অবস্থার আরেকটি নেতিবাচক বিষয়।

 

চলচ্চিত্র উপভোগ করা দর্শকদের সংখ্যা চলচ্চিত্র বাজার হিসাব রক্ষার একটি সূচক। চলচ্চিত্র উপভোগ করা দর্শক মানে- প্রতি বছর কমপক্ষে একবার প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে চলচ্চিত্র দেখা মানুষ। চলচ্চিত্র উপভোগ করা দর্শকদের অনুপাত হলো দেশের মোট লোকসংখ্যার মধ্যে চলচ্চিত্র উপভোগ করা দর্শকদের হার।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী দক্ষিণ কোরিয়ায় চলচ্চিত্র উপভোগ করা  লোকসংখ্যা সবচে বেশি। যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ৭৯ শতাংশ। দক্ষিণ কোরিয়ায় ৫ কোটি ২০ লাখ মানুষের মধ্যে ৪ কোটি ১০ লাখ লোক প্রতিবছর একবার প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে চলচ্চিত্র উপভোগ করেন। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সে, ইতালি ও ব্রিটেনে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৭৪ শতাংশ, ৬৩ শতাংশ, ৫৫ শতাংশ এবং ৫১ শতাংশ। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে জাপানের জনসংখ্যা সবচে কম এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই সংখ্যা ৩৯ শতাংশে নেমে এসেছে।

চীনের চলচ্চিত্র বাজার নিয়ে আপাতত কর্তৃপক্ষের পরিসংখ্যান নেই।

 

চীনের সার্বিক সমাজ তদন্ত বা সিজিএসএস ২০১৭ সালে ১২,৫৮১জন লোক নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে। এ থেকে বোঝা যায়, এ ১২,৫৮১ লোকের মধ্যে ৪৫৪১ জন লোক প্রতি বছর কমপক্ষে একবার প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে চলচ্চিত্র উপভোগ করেছেন। অনুমান করা যায় যে, চীনে চলচ্চিত্র উপভোগ করা দর্শকের অনুপাত প্রায় ৩৬.১ শতাংশ। তবে এ ১২,৫৮১জনের জরিপের নমুনা চীনের বাস্তব লোকসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বেইজিং, শাংহাই, কুয়াংচৌ ও শেনচেংয়ের মতো বড় শহরে চলচ্চিত্র উপভোগ করা লোকসংখ্যার অনুপাত ৪২ শতাংশ, চীনের মুলভূভাগে এই সংখ্যা প্রায় ৩২ শতাংশ এবং চলচ্চিত্র উপভোগ করা লোকসংখ্যা প্রায় ৪৫ কোটি।

 

কয়েক বছর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আমরা মনে করি, উত্তর আমেরিকা, জাপান, ইউরোপ এবং হংকং ও তাইওয়ান অঞ্চলের তুলনায় চীনের মুলভূভাগের দর্শকদের চলচ্চিত্র উপভোগের অভ্যাস আসলেরই দক্ষিণ কোরীয় জনগণের মতো। তবে চলচ্চিত্র উপভোগ করার হারের তুলনায় আমাদের বৃদ্ধির আরও জায়গা আছে। এই প্রবৃদ্ধি অবশ্যই চীনের শহরায়ন ও দারিদ্র্যমুক্তির গতি, মাথাপিছু নিষ্পত্তিযোগ্য আয় এবং মাথাপিছু স্ক্রিন দেখার সংখ্যাসহ বিভিন্ন প্রবৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত।

 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বক্সঅফিস ও বার্ষিক দর্শকসংখ্যার প্রবৃদ্ধি অব্যাহতভাবে কমেছে। পরবর্তীতে মুলভূভাগে চলচ্চিত্র বাজারের সিলিং বাড়াতে চাইলে প্রধানত দুটি দিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত্।

 

প্রথমে চলচ্চিত্র ব্যক্তিদের জন্য অব্যাহতভাবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাণ, শ্রেষ্ঠ আমাদানিকৃত চলচ্চিত্র প্রদর্শন নিশ্চিত করা এবং চলচ্চিত্র উপভোগের ক্ষেত্রে সুবিধা দেওয়া উচিত্।

চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের বাস্তবভিত্তিক চলচ্চিত্র তৈরি করা উচিত্। ভিজ্যুয়াল প্রভাব এবং জনগণের পছন্দের বিষয় দর্শকদের আকর্ষণ বৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

 

দ্বিতীয়ত, প্রেক্ষাগৃহের সেবাও ভালোভাবে করা উচিত্। স্ক্রিনের সংখ্যা বাড়ানো হলো চলচ্চিত্র উপভোগ করা দর্শকদের সংখ্যা বৃদ্ধির খুব ভালো উপায়। বর্তমানে চীনের প্রেক্ষাগৃহের লাইসেন্সের আবেদন বেড়েছে। স্ক্রিনের সংখ্যা বাড়াতে উত্সাহ দেওয়া হচ্ছে। প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা বাড়ানো এবং এর সেবার মান বাড়ানো উচিত্। বাইরে থেকে দেখা যায়, কোনো কোনো উন্নত শহরের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে প্রেক্ষাগৃহ বেশ পুরনো হয়েছে। যথাসময় সংস্কার করা উচিত্।

 

প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দর্শকদের চলচ্চিত্র উপভোগের অভ্যাস বজায় রাখা দরকার। এটি বক্সঅফিসের প্রভাব বাড়ানোর খুব গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। পাশাপাশি প্রযোজক, প্রকাশ ও প্রজেকশন পাশ এ তিনটি পক্ষের কাজ।

তা ছাড়া, ভবিষ্যতে দেশে শহরায়ন বাড়ানো হবে। এ বছরের দুই অধিবেশনে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের অর্থনীতি ও সমাজের উন্নয়ন-সংক্রান্ত চতুর্দশ পাঁচশালা পরিকল্পনা এবং ২০৩৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য’ গৃহীত হয়। এতে শহরায়নের গতি বাড়ানো হয়। তাই ভবিষ্যতে চীনের নাগরিকদের ভোগের মান বাড়ানো, শহরায়নের প্রক্রিয়া গভীর করা এবং সাংস্কৃতিক পণ্যের প্রতি জনগণের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্র বাজারের আরো উন্নয়নের সুযোগ আছে।

 

চলচ্চিত্র মহলের কাঠামোগত সংস্কার দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।

চীনের অর্থনীতি অভ্যন্তরীণ চাহিদার ওপর নির্ভর করে; সেই সঙ্গে বহির্বিশ্বের প্রভাবও বাদ দেওয়া যায় না। চীনের চলচ্চিত্র বাজারে অভ্যন্তরীণ অবদান ৯০ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে চীনা চলচ্চিত্রের অবদান খুব কম। তাই চীনের চলচ্চিত্রের বাহ্যিক আউটপুট নিয়ে অনেক সন্দেহ সৃষ্টি হয়।

 

চীনের ব্রডকাস্টিং ও চলচ্চিত্র সাধারণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বিদেশের বাজারে চীনের চলচ্চিত্রের আয়ের পরিমাণ বক্সঅফিসের মোট আয়ের মাত্র ৭.৬ শতাংশ। অন্যদিকে, বিদেশি বাজার থেকে ভারতের চলচ্চিত্রের আয়ের পরিমাণ দেশটির বক্সঅফিসের মোট আয়ের ৩০ শতাংশ। বিদেশে জাপানি চলচ্চিত্রের বক্সঅফিসের আয় তার মোট আয়ের ১৫ শতাংশ।

 

একটা উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, সারা বিশ্বে ‘Wolf Warriors’ নামে চলচ্চিত্রটির বক্সঅফিসের মোট আয় ৮৭ কোটি মার্কিন ডলার। তবে এর মধ্যে ৮৫.৪ কোটি ডলার চীনের মুলভূভাগ থেকে এসেছে। বিদেশের বক্সঅফিসে আয় মাত্র ১ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার এবং যা বক্সঅফিসের মোট আয়ের মাত্র ১.৮৪ শতাংশ। অন্য চলচ্চিত্রের তুলনায় বিদেশে ‘Wolf Warriors’ চলচ্চিত্রটির বক্সঅফিসের আয় ভালো হয়েছে। আসলে অনেক বছর আগে বিদেশে চীনা চলচ্চিত্রের বাহ্যিক আউটপুটের ক্ষমতা ভারতের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে।

সংশ্লিষ্ট পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০১৭ সালে উত্তর আমেরিকায় ভারতের চলচ্চিত্র ১০ কোটি মার্কিন ডলার আয় করে এবং চীনা ভাষার চলচ্চিত্র এক কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলারেরও কম আয় করে।

চীনের দেশীয় বাজার বিস্তৃত হলেও চীনা ছবি হলিউডের চলচ্চিত্রের মতো সারা বিশ্বে সমাদর পায় নি। তবে ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ অন্য দেশের চলচ্চিত্রের সাংস্কৃতিক রপ্তানি এবং বিশ্বের বক্সঅফিসের অবস্থা থেকে বলা যায়, চীনা ভাষার চলচ্চিত্রের বাজার আরো সম্প্রসারিত হতে পারে।

 

২০২০ সালে অনেকে প্রেক্ষাগৃহের চলচ্চিত্রকে ‘গোধূলি শিল্প’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তবে উত্পাদন পুনরুদ্ধারের পর থেকে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের বক্সঅফিসে এবং বেশ কয়েকটি রেকর্ড ভেঙে যায়। এতে বোঝা যায়, প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র বাজারের উন্নয়নের আরো সম্ভাবনা আছে। বলা যায়, প্রেক্ষাগৃহের চলচ্চিত্র বাজারে এখন মাত্র ৫০ শতাংশ ক্ষমতা রয়েছে। ভবিষ্যতের বাজার আরো সম্প্রসারণ করা এবং আরো বেশি দর্শক আকর্ষণ করা যায়। তবে, আগামী ১০ বছরের মধ্যে আমরা চলচ্চিত্র বাজারের সিলিং স্পর্শ করতে পারবো না।

(লিলি/তৌহিদ/শুয়ে)