চীনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের প্রতি প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের শুভেচ্ছা ও প্রসঙ্গকথা
2021-09-13 17:29:42

বন্ধুরা, ১০ সেপ্টেম্বর ছিল চীনের শিক্ষক দিবস। প্রতি বছরের এই দিনটি চীনা শিক্ষকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। চলতি বছর চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং শিক্ষক হুয়াং তা নিয়ানের মতো শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে চীনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মান ও যোগ্যতার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। আজকের আসরে প্রেসিডেন্ট সি’র চিঠি ও শিক্ষক হুয়াং তা নিয়ানের গল্প শেয়ার করবো।

 

চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তাঁর চিঠিতে লিখেছেন, সেরা শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করা প্রয়োজন। চরিত্র ও নৈতিকতা—সব দিক দিয়েই শিক্ষকদের যোগ্যতা থাকা দরকার। সেরা শিক্ষকদের উচিত শিক্ষক হুয়াং তা নিয়ানের মতো মনোযোগ দিয়ে গবেষণাকাজ করা; নব্যতাপ্রবর্তনের জন্য প্রচেষ্টা চালানো; অন্য নতুন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে নিজেদের অবদান রাখা। এতে তাঁরা চীনের সমাজের আধুনিক উন্নয়নে আরও বেশি অবদান রাখতে সক্ষম হবেন এবং শ্রেষ্ঠ যুবসমাজ নির্মাণ করতে পারবেন।

 

জনাব হুয়াং তা নিয়ান ১৯৫৮ সালে চীনের কুয়াংসি চুয়াং জাতির স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের রাজধানী নাননিং শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি পিতা-মাতার সাথে গ্রামাঞ্চলে যান এবং সেখানে উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯৭৫ সালের অক্টোবর মাসে তিনি পরীক্ষা পাস করে কুইকাং জেলার ভূতাত্ত্বিক দলে যোগ দেন এবং প্রথমবারের মতো এভিয়েশন পদার্থবিদ্যার জ্ঞান সম্পর্কে জানতে পারেন। পরে গবেষক হিসেবে চাকরি শুরু করেন।

 

১৯৭৭ সালে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি-পরীক্ষা ‘কাওখাও’ আবার চালু হয়। তখন তিনি ছাংছুন শহরের ভূতত্ত্ব একাডেমিতে ভর্তি হন এবং স্নাতক হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স ডিগ্রীও লাভ করেন। এর পর তিনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন।

 

১৯৯৬ সালে তিনি প্রথম শিক্ষার্থী হিসেবে ব্রিটিশ লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওফিজিক্স বিভাগের ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। চীনে ফিরে আসার পর তাকে আবার ব্রিটেনে গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানকাজের ওপর গবেষণা করতে পাঠানো হয়। ব্রিটেনের ক্যাম্ব্রিজ আর্কেক্স জিওফিজিক্স কোম্পানির সিনিয়ার গবেষক হিসেবে তিনি টানা ১২ বছর কাজ করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি বিশ্বের এভিয়েশন জিওফিজিক্স গবেষণা খাতের শীর্ষ গবেষকে পরিণত হন। ২০০৯ সালে তিনি চিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তবে ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৮ বছর।

 

২০১৭ সালের মে মাসে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের উদ্যোগে শিক্ষক হুয়াং তা নিয়ানকে চীনা শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের দৃষ্টান্ত হিসেবে বেছে নেওয়া হন এবং তাঁর গল্পও আরও ব্যাপকভাবে জনারণ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

 

শিক্ষক হুয়াং’র সহকর্মী তাঁকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। তাতে বলা হয়েছে, শিক্ষক হুয়াং’র সহকর্মী হিসেবে তিনি তাঁর জীবনযাপন, চরিত্র ও কাজের স্টাইল সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন। এটা খুবই সৌভাগ্যের ব্যাপার। সহকর্মী হিসেবে তিনি ছিলেন কোমল হৃদয়ের অধিকারী, তবে গবেষক হিসেবে তিনি ছিলেন আপসহীন মনোযোগী। চিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সময় তিনি শুধু গবেষণা-বাজেট পাওয়ার চেষ্টা করেননি, বরং যুবগবেষকদের প্রশিক্ষণে অনেক পরিশ্রম করেছেন।

 

দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে উচ্চমানের ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ অতি জরুরি। গবেষণার কাজ অনেক ব্যস্ততার। তারপরও অধ্যাপক হুয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি,  দেশি-বিদেশি সেরা অধ্যাপক ও পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ জানিয়ে বিভিন্ন সেমিনার ও সংলাপের আয়োজন করতেন, যাতে তার শিক্ষার্থীদের পেশাগত মান আরও উন্নত হয়।

 

পড়াশোনার কাজে তিনি বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারা ও স্বাধীন চিন্তার চর্চার ওপর গুরুত্ব দিতেন। তাঁর দৃষ্টিতে শিক্ষকরা শুধু জ্ঞান দিয়ে যাবেন, তা নয়; শিক্ষার্থীরা যাতে নিজেরাই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে আগ্রহী হয়, সেই দিকেও শিক্ষকদের খেয়াল রাখতে হবে। সেরা শিক্ষক কেবল নিজের চিন্তাভাবনা অনুসারে শিক্ষার্থীদের  সবাইকে একই ধরনের জ্ঞান বিতরণ করেন না, বরং তাদের নিজ নিজ প্রাধান্য ও দক্ষতাকে উত্সাহিত করেন; তাদেরকে তাদের প্রয়োজন অনুসারে সহায়তা দেন। এতে শিক্ষার্থীরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্য যথেষ্ট দক্ষ হয়ে গড়ে ওঠে।

 

শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মান উন্নয়নে এবং তাদেরকে জ্ঞান অর্জনের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে শিক্ষক হুয়াং নিজের টাকা ব্যয় করে পরীক্ষামূলক ক্লাসের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ভালো মানের ল্যাপটপ কিনে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তাদের জন্য বিদেশ থেকে উন্নত মানের সফ্টওয়েয়ার কিনেছেন, ইংরেজি ভাষার ম্যাগাজিন সাবস্ক্রাইব করেছেন। এসবই তিনি করেছেন শিক্ষার্থীদের উত্সাহিত করতে।

 

শিক্ষক হুয়াং মনে করতেন, প্রত্যেক শিক্ষার্থী একেকটা আনকাট জেড পাথরের মতো। নির্দিষ্ট ও উপযোগী সহায়তা পেলে সবাই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হতে পারে। তিনি শিক্ষার্থীদের বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করে তাদের সাথে গভীর আলোচনা করতেন, তাদের চিন্তাভাবনা ও আগ্রহ জানার পর সংশ্লিষ্ট পেশাগত গবেষণার দিক নির্ধারণ করে দিতেন এবং শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারা ও দক্ষতার চর্চাকে উত্সাহিত করতেন। পুথিগত বিদ্যার পাশাপাশি, তিনি শিক্ষার্থীদের চরিত্রগঠনে ও মানসিক দক্ষতা অর্জনের ওপরও গুরুত্ব দিতেন।

 

মাস্টার্স বা ডক্টরেট পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চ মানের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতেন শিক্ষক হুয়াং। তাঁর সহায়তায় শিক্ষার্থীরা ব্যাপকভাবে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন প্রকল্পে অংশ নিয়েছেন, বাস্তব অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করার মাধ্যমে গবেষণায় আরও দক্ষ হয়ে উঠেছেন। তাঁর শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ ঐতিহ্যিক ভূতত্ত্বের মৌলিক তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন, কেউ কেউ ড্রোন নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে মনোযোগ দেন এবং কেউ কেউ উন্নত কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে ভূগোল সফটওয়্যার নির্মাণ করেন।

 

অধ্যাপক হুয়াং’র পিতামাতা উভয়েই কুয়াংসি ভূতাত্ত্বিক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। ছোটবেলা থেকে তিনি পিতামাতার প্রভাবে ভূবিজ্ঞান সম্বন্ধে জানার সুযোগ পান। যদিও ভূতাত্ত্বিক বিষয়ের গবেষণা অনেক কঠিন, তবে বাবা-মার কাজ তাকে এদিকে আকৃষ্ট করে।  তাঁর বাবা-মা ছাত্রছাত্রীদের নিজের সন্তানের মতো দেখতেন এবং প্রতি সপ্তাহের ছুটিতে তাঁদের বাড়ি অনেকটা বড় ক্লাসের মতো হয়ে যেতো ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতিতে। ছাত্রছাত্রীদের সাথে পড়াশোনা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি  তাদের জন্য মজার মজার খাবার রান্না করতেন বাবা-মা। হুয়াং’র জন্য বাবা-মা ছিলেন দৃষ্টান্ত ও অনুপ্রেরণা। শিক্ষকদের ভাবমূর্তি তাঁর কাছে ছিল অনেক উজ্জ্বল।

 

বড় হওয়ার পর তিনিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন। ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি কাওখাও পরীক্ষা পাস করে ছাংছুন ভূতাত্ত্বিক একাডেমিতে ভর্তি হন। কুয়াংসি থেকে উত্তরাঞ্চলের ছাংছুন শহর আসার পর স্থানীয় ঠাণ্ডা আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়াতে পারেননি শুরুর দিকে। ফলে একাডেমির শিক্ষকরা দক্ষিণ চীনের ছাত্রছাত্রীদের জন্য মোটা কাপড় ও লেপ সংগ্রহের প্রস্তুতি নেন। হুয়াং শিক্ষকদের কাছ থেকে পরিবারের আন্তরিকতা ও যত্ন পান। কুয়াংসি’র শিক্ষার মান উত্তর চীনের তুলনায় খারাপ। তাই একাডেমিতে ভর্তির পর তিনি অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় আরও বেশি পরিশ্রম করতেন। শিক্ষকরাও ধৈর্য নিয়ে তাকে সহায়তা দিতেন। মাত্র এক সেমিস্টার পর তিনি ক্লাসের সেরা শিক্ষার্থী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যান। এ সম্পর্কে হুয়াং বলেন, যদিও তাঁর শিক্ষকরা চীনের ভূতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞ, তবে তারা খুবই আন্তরিক; তাদের চরিত্র ও পেশাদারিত্ব হুয়াংকে মুগ্ধ করেছে।

 

বিদেশ ও চীনে শিক্ষকতার পার্থক্য তুলনা করে হুয়াং বলেন, চীনে সেরা শিক্ষক হতে চাইলে কেবল শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া নয়, বরং বাবা-মায়ের মতো তাদের চরিত্র ও নৈতিকতার চর্চার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। চীনের একটি প্রবাদ রয়েছে, আর তা হল: একদিনের শিক্ষক সারা জীবন পিতামাতার মতো। চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদের সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী লিউ ইয়ান তুং চিলিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছেন। একবার তিনি বলেছিলেন, শিক্ষক কোনো মেধাবী শিক্ষার্থীর মেধা নষ্ট হতে দিতে পারেন না। এ সম্পর্কে অধ্যাপক হুয়াং বলেন, দেশের চাহিদা বিবেচনা করলে, শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের যোগ্যতা থাকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক চিন্তাভাবনা আর সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা থাকতে হবে। শিক্ষকরা মানবজাতির আত্মার মতো। তাই শ্রেষ্ঠ শিক্ষক তৈরি করতে সর্বপ্রথমে শ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষক প্রয়োজন। অধ্যাপক হুয়াং বলেছিলেন, যদি জীবনে আরেকবার সুযোগ আসে, তাহলে তিনি আবার শিক্ষকতার পেশা বেছে নেবেন এবং তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন। কারণ, শিক্ষক হওয়ার মাধ্যমে তিনি নিজের অবদান রাখতে পারেন, যা অধ্যাপক হুয়াং’র জন্য অতি তাত্পর্যপূর্ণ ব্যাপার।

সুপ্রিয় বন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা এখানে শেষ হয়ে এলো। আমাদের অনুষ্ঠান যারা মিস করেছেন, তারা আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। ওয়েবসাইট ঠিকানা www.bengali.cri.cn,ফেসবুকে CRIbangla মাধ্যমে চীন ও বিশ্ব সম্পর্কে আরও অনেককিছু জানতে পারেন। তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন, আগামী সপ্তাহে আবার কথা হবে,যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)