তাইওয়ানের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক লি শিং
2021-09-15 16:13:46

তাইওয়ানের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক লি শিং_fororder_例行1

লি শিং, তাইওয়ানিজ চলচ্চিত্রের গ্র্যান্ড মাস্টার, তাইওয়ান প্রণালীর দু’পারের চলচ্চিত্র খাতের জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব এবং চীনা ভাষার চলচ্চিত্রের আজীবন স্বেচ্ছাসেবক। চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি তিনি তাইওয়ানের দু’তীরের বিনিময় কমিটির পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছেন। ১৯ অগাস্ট রাতে তিনি হৃদরোগ ও ফুসফুসের সমস্যা নিয়ে তাইপেই শহরে মারা যান। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিলো ৯১ বছর।

 

১৯৩০ সালে শাংহাই থেকে শুরু করে ২০২১ সালে তাইপেই শহর পর্যন্ত জনাব লি অসাধারণ জীবন কাটিয়েছেন। তিনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নানা অনুভূতি বর্ণনা করেছেন এবং তাইওয়ান প্রণালীর দুই তীরের সংযোগ স্থাপন করেছেন।

তাইওয়ানিজ চলচ্চিত্র জগতে ‘He Never Gives Up’ নামের চলচ্চিত্রটি উল্লেখযোগ্য। সাধারণ দর্শকরা ছিন হান নামে একজন অভিনেতার সঙ্গে সুপরিচিত হন। তবে যারা এ চলচ্চিত্র পরিচালকের নাম জানেন, তাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। পরিচালক লি শিংয়ের মৃত্যুতে ছিন হান শোক প্রকাশ করে বলেন, আশা করি, আমাদের প্রিয় পরিচালক লি শিং স্বর্গের যে কোনো স্থানে চলচ্চিত্র তৈরি করবেন।

 

‘He Never Gives Up’ নামে চলচ্চিত্রটি হলো ১৯৭৮ সালে লি শিংয়ের পরিচালিত একটি চলচ্চিত্র। তখন তিনিই তাইওয়ানের চলচ্চিত্র মহলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। লি শিং স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, নিজের চলচ্চিত্র যাত্রার শুরু হয় স্কুল থেকে। এক সাক্ষাত্কারে লি শিং বলেছিলেন, সু চৌ শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় পরিচালক ফেই মু’র চলচ্চিত্র ‘Spring in a Small Town’ দেখার পর তিনি নাটক ও চলচ্চিত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন।
 

১৯৪৮ সালে লি শিং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাইওয়ানে চলে যান। তিনি ন্যাশনাল তাইওয়ান নর্মাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। সেসময় প্রায়শই স্কুল ড্রামা ক্লাবের পারফরম্যান্সে অংশগ্রহণ করতেন এবং পরিচালক হিসেবে কাজ করতেন।

লি শিং ছিলেন তাইওয়ান চলচ্চিত্রের অগ্রগামী ব্যক্তিত্ব। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে তিনি সুস্থ এবং বাস্তবসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণের চেষ্টা করেন। প্রায় ৩০ বছরে তিনি মোট ৫২টি চলচ্চিত্র তৈরি করেন। তিনি ‘Beautiful Duckling’, ‘Autumn Execution’ এবং ‘He Never Gives Up’ এ তিনটি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনবার গোল্ডেন হর্স অ্যাওয়ার্ডসের শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার লাভ করেন। তা ছাড়া, তার আরো ৭টি চলচ্চিত্র গোল্ডেন হর্স অ্যাওয়ার্ডসের সেরা ফিচার ফিল্ম পুরস্কার অর্জন করে। তাকে গোল্ডেন হর্স অ্যাওয়ার্ডসের আজীবন সম্মাননার পুরস্কারেও ভূষিত করা হয়।

 

লি শিংয়ের ক্ল্যাসিকাল চলচ্চিত্রগুলো হলো- ‘The Story of A Small Town’ ও ‘China, my native land’ এবং ‘The silent wife’সহ চীনের আধুনিক লেখক ছিং ইয়াওয়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র।

 

তাইওয়ানের চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ চিও সিয়োং পিং লি শিংয়ের মূল্যায়ন করে বলেন, তার শিল্পকর্ম তার নিজের মতোই, ঐতিহ্য ও নৈতিকতা সমুন্নত রেখেছে। তিনি পরিবারকে ভালোবাসেন এবং আবেগের প্রশংসা করেন। পরিবার হলো পরিচালক লি শিংয়ের আধ্যাত্মিক চেতনার কেন্দ্রীয় বিষয়। পারিবারিক নীতিশাস্ত্রের মতো যা মনোমুগ্ধকর তা হলো- তাইওয়ান ও চীনের প্রতি পরিচালক লি’র ভালোবাসা ও অনুভূতি। তিনি বলেন, ‘End of the Alley Way’ এবং ‘China, my native land’সহ বিভিন্ন শিল্পকর্মে গত শতাব্দীতে ৩০ বা ৪০ দশকে চীনের চলচ্চিত্রে ঐতিহ্যের চিহ্ন রয়েছে।

 

মুল ভূভাগে চীনা চলচ্চিত্রের শতবর্ষ স্মরণে আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশ নেওয়ার সময় লি শিং বলেছিলেন যে, তিনি চীনা চলচ্চিত্র শিল্পের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বড় হয়েছেন। ‘Song of The Fishermen’, ‘Angels on the Road’, ‘Crossroads’ এবং ‘Spring River Flows East’সহ অসংখ্য ক্ল্যাসিকাল চলচ্চিত্র, বিশেষ করে- সেগুলোতে তুলে ধরা প্রবীণ চলচ্চিত্র ব্যক্তিদের মানবিক যত্নের চেতনা ও গভীর মতাদর্শগত ধারণা চীনের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বহন করেছে এবং তার রচনার চিন্তাধারায় প্রভাব ফেলেছে।

 

চিও সিয়োং পিং বলেন, পরিচালক লি শিং মূল ভূখণ্ড থেকে চীনা ক্লাসিক চলচ্চিত্রের আখ্যান এবং নান্দনিক ঐতিহ্যকে তাইওয়ানে নিয়ে আসেন এবং তার অনন্য সিনেমার শিল্পশৈলীও ধাপে ধাপে ছড়িয়ে পড়ে।

বলা যায়, তাইওয়ানের চলচ্চিত্র মহলে লি শেং অনেক বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রশিক্ষণ দেন।

হাউ সিও-সিয়েন হচ্ছেন লি শিংয়ের পরিচালিত ‘he Heart with Million Knots’ নামে চলচ্চিত্রের উপ-পরিচালক। তিনি বলেন, পরিচালক লি তাইওয়ানে চলচ্চিত্র ব্যবস্থাপনা স্থাপন করেছেন এবং তরুণ পরিচালকদের জন্য বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন।

 

গত শতাব্দীর ৮০’র দশকের শেষ দিকে তাইওয়ান প্রণালীর দু’পারের সমন্বয় বৃদ্ধি পায়। এরপর লি শিংয়ের হাতে নতুন দায়িত্ব আসে। ১৯৯০ সালে চাইনিজ ফিল্ম অ্যাসোসিয়েশনের আমন্ত্রণে তার নেতৃত্বে তাইওয়ানের চলচ্চিত্র মহলের ব্যক্তিরা গবেষণা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে বেইজিংয়ে আসেন। তারপর তার নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল দ্য গোল্ডেন রুস্টার অ্যাওয়ার্ডের কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার জন্য মুল ভূভাগে আসেন। সেবার তাইওয়ানের চলচ্চিত্র মহল প্রথমবারের মতো মুল ভূভাগের চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে অংশ নেয়। ১৯৯৩ সালে তিনি দ্য গোল্ডেন রুস্টার অ্যাওয়ার্ডসের কার্য-নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে বহাল থাকেন। তার চেষ্টায় গোল্ডেন হর্স অ্যাওয়ার্ডসের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে মুল ভূভাগের চলচ্চিত্র মহলের প্রতিনিধিদল তাইওয়ানে যায়।

 

বহু বছর ধরে দু’তীরের চলচ্চিত্রের বিনিময় বেগবান করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তিনি। তিনি বলেছিলেন যে, আমার গোটা জীবনে আমি দু’তীরের চলচ্চিত্র এবং চীনের চলচ্চিত্র খাতের উন্নয়নে অবদান রাখতে চাই। মুলভূভাগে বহুবার লি শিংয়ের চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। তিনি নিজের শিল্পকর্মের কপি অনেকবার চায়না ফিল্ম আর্কাইভে দান করেছেন।

 

বহুবছর আন্তরিক বিনিময়ের পর মুল ভূভাগের চলচ্চিত্র ব্যক্তিদের সঙ্গে লি শিংয়ের সুগভীর মৈত্রী সৃষ্টি হয়। যখন মুল ভূভাগের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সিয়ে চিন মারা যান, তখন তিনি বিশেষ করে তাইওয়ান থেকে শাংহাইয়ে এসে সিয়ে চিনের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন।

২০০৯ সালে তাইওয়ানের দু’তীরের চলচ্চিত্র বিনিময় কমিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ৭৯ বছর বয়সী লি শিং এ কমিটির সদস্য হিসেবে মনোনীত হন। একই বছর এই কমিটি চীনের চলচ্চিত্র তহবিলের সঙ্গে যৌথভাবে দু’তীরের প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে।

 

গত বছর মহামারীর কারণে পিছিয়ে দেওয়া দু’তীরের ১২তম চলচ্চিত্র প্রদর্শনী কিছুদিন আগে আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়। চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর পোস্টারে পরিচালক লি শিংয়ের ফুটফুটে কমিক ইমেজ ছাপানো হয়। চলচ্চিত্র প্রদর্শনী প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, চলতি বছর মহামারী পরিস্থিতিতে দু’তীরের চলচ্চিত্র ব্যক্তিদের সফর বিনিময় করা সম্ভব হবে না। তবে তাইপেই ও বেইজিংয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন একে অপরের বাজার ও শিল্পের উন্নয়নের প্রবণতা বজায় রাখার গুরুত্বপূর্ণ চ্যানেল। দু’তীরের চলচ্চিত্র সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ও সংহতকরণের ফলে চীনের চলচ্চিত্রের ধারণা আরো সম্পূর্ণ হবে এবং দু’তীরের অভিন্ন সমৃদ্ধি ও উন্নতি বাস্তবায়িত হবে।

 

‘পরিচালক লি শিংয়ের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছি। ৩০ বছর ধরে মুল ভূভাগ, তাইওয়ান ও হংকংয়ের চলচ্চিত্র পরিচালকদের বিনিময় ও সহযোগিতার জন্য তার নিরলস প্রচেষ্টা ও বিশাল অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই।’ মুল ভূভাগের বিখ্যাত পরিচালক সিয়ে ফেই নিজের মাইক্রোব্লগে এভাবেই বলেছেন।

(লিলি/তৌহিদ/শুয়ে)