রূপপুরে পরমাণু চুল্লি স্থাপন: পারমাণবিক বিদ্যুৎ ক্লাবের পথে বাংলাদেশ
2021-10-10 19:24:04

দেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পথে আরও একধাপ এগুলো বাংলাদেশ। পাবনার রূপপুরে নির্মিয়মান পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটে রি-অ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল বা পরমাণু চুল্লি স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে আজ রোববার। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেন। এর মধ্য দিয়ে পারামাণবিক বিদ্যুৎ ক্লাবে পদার্পণের পথে আরও একধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ।

চুল্লি স্থাপন কাজ উদ্বোধনের পর শেখ হাসিনা দিনটিকে বাংলাদেশের জন্য গর্বের বলে অভিহিত করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৬১ সালে বঙ্গবন্ধু রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিলেও তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তা বাতিল করে দেয়। এ জন্য বরাদ্দ অর্থ দিয়ে তারা পশ্চিম পাকিস্তানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানায়। পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে স্বামী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার অবদানের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

এখানে আমরা রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনাক্রম স্মরণ করতে পারি।

১৯৬১ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন বঙ্গবন্ধু। এ জন্য পাবনার ঈশ্বরদী থানার পদ্মা তীরবর্তী রূপপুরকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। এজন মোট ২৯২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়।

কাজ কিছুদূর এগুলোও ১৯৬৯-৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ২০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ প্রকল্পটি বাতিল করে দেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে ৭৫ সালের মধ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণে পুনরায় উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর এ উদ্যোগ ফের থমকে যায়। 

১৯৯৭ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে উদ্যোগ নেন। সরকার নিউক্লিয়ার পাওয়ার অ্যাকশন প্ল্যান ২০০০ অনুমোদন করে।

১৩ মে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং রাশান ফেডারেশন স্টেট এটমিক এনার্জি কর্পোরেশন- রোসাটোম-এর মধ্যে এ বিষয়ে একটি সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষরিত হয়।

২০১০ সালের ১০ নভেম্বর জাতীয় সংসদে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের প্রস্তাব পাশ হয়।

দীর্ঘ প্রস্তুতির পর ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের কংক্রিট ঢালাইয়ের কাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারই পথ ধরে রোববার প্রথম ইউনিটে পরমাণু চুল্লি স্থাপনের কাজ উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী।

২০২৩ সালের মধ্যে প্রথম ইউনিটের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে দিনে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। আর দুটি ইউনিট নির্মাণ সম্পন্ন হল বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে ২৪শো মেগাওয়াট।

বাংলাদেশের ইতিহাসে একক বৃহত্তম প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার কো্টি টাকা- যা বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের এক পঞ্চমাংশের বেশি।

বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু হলে এটি দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হবে এবং জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাবে বলে আশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শান্তিপূর্ণ কাজে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তির ব্যবহার করবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আরেকটি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে সরকারের পরিকল্পনার কথাও জানান।

রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন বাংলাদেশের জন্য নিশ্চয় গৌরবের। দেশের অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এটাও দূরাশা নয়। তবে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে শুরু থেকেই একটা নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বলে আসছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান এ উদ্বেগ নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাত্তায় সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রূপপুরে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা বলেছেন।

নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের দিক ছাড়াও রাশিয়ার কাছ থেকে বুঝে নেওয়ার পর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি যথাযথভাবে পরিচালনাও একটি বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিচালনার জন্য গ্রিড নির্মাণ, ফুয়েল হ্যান্ডেলিং ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সর্বোচ্চ দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনবল। পাশাপাশি রেগুলেটরি কমিশনে দক্ষ ও অভিজ্ঞদের রাখার পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিকুল ইসলাম।

মাহমুদ হাশিম

ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।