Web bengali.cri.cn   
তিব্বতি জাতির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির ভাণ্ডার: লা ই
  2014-02-12 15:58:55  cri

গ্রামীণ ডাকপিয়ন সাধারণত সবুজ রংয়ের কাপড় পরেন এবং পিঠে একটি বড় ডাকথলি নিয়ে ঘরেঘরে চিঠিপত্র বিলি করার উদ্দেশে পায়ে হাঁটতে বা সাইকেল চালাতে থাকেন। চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শিনচিয়াং উয়েগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের একদম উত্তরে আলেথাই বিভাগের হাবাহো জেলায় একটি অপরিচিত ডাকপথ আছে। এই পথের নাম মাবান ডাকপথ। আগে সেটা পিচঢালা রাস্তা ছিল না, কেবল মাটি রাস্তা ছিল। ওই সময় কোনো চিঠিপত্র বাসিন্দাদের হাতে পৌঁছে দিতে হলে ডাকপিয়নকে পায়ে হেটে বা ঘোড়ায় চড়ে সেখানে যেতে হতো। সুতরাং এই রাস্তা ' মাবান ডাকপথ' বলে আখ্যয়িত হয়।

সুপ্রিয় শ্রোতা, এখন শুনুন শিনচিয়াং গণবেতারের সংবাদদাতা জান সু মিন এবং প্রতিবেদক গুও ওয়েন জিয়েন ও লিয়েডং পাঠানো একটি রেকর্ডিং ভিত্তিক প্রতিবেদন। এটির শিরোনাম: 'জিএনসিবিয়ে ও মাবান ডাকপথ'।

শিনচিয়াং উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের আলেথাই বিভাগের হাবাহো জেলায় একটি থানা আছে। থানাটির নাম তিয়েরেখেটি থানা। ওখানকার দৃশ্য খুব সুন্দর। কিন্তু ওই থানায় যাওয়া খুব কষ্টকর। কেননা, থানার চার দিকে বড় বড় পাহাড়; সেখানে যাওয়ার রাস্তা আঁকাবাঁকা। সুতরাং, সেখানের সুন্দর দৃশ্য দেখতে চাইলেও যাওয়ার সাহস ছিল না লোকদের। ওই থানায় যেতে হলে কয়েক দশক ধরে ডাকপিয়নকে পায়ে হাঁটতে বা ঘোড়ার পিঠে চড়তে হত।

মাবান ডাকপথের নাম উল্লেখ করলে থানার একজন ডাকপিয়নের কথা মনে পড়ে স্থানীয় মানুষদের। তিনি হলেন হাবাহো জেলার হাসাক জাতির ডাকপিয়ন জিএনসিবিয়ে মোহেমেইটি। তার বয়স ৫১ বছর। গত ৩২ বছর ধরে তিনি ডাকপিয়নের কাজে নিয়োজিত। এর মধ্যে ৭ বছরে তিনি 'মাবান ডাকপথে' যাতায়াত করেন। তিয়েরেখেটি থানা হাবাহো জেলার উত্তর দিকে ৭৭ কিলোমিটারের দূরে অবস্থিত। এর উত্তর দিকে আয়থাই পবর্তমালা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ওখানকার গড় উচ্চতা ১০৭২ মিটার। মোট জনসংখ্যার মধ্যে হাসাক জাতির লোকসংখ্যা ৮০ দশমিক ৩ শতাংশ। হাসাক জাতির ভাষায় 'তিয়েরেখেটি' মানে পোলার গাছ। কারণ ওই থানার পোলার (polar) গাছ অত্যন্ত বিখ্যাত। গ্রীষ্মকালে ওখানের আবহাওয়া আরামদায়ক এবং দৃশ্য খুব সুন্দর। শীতকালে চারদিকের পাহাড়গুলো তুষারে ঢাকা থাকে। তখন পিচঢালা রাস্তা ছিল না বলে স্থানীয় অধিবাসীরা পরষ্পরকে কোনো খবর বা চিঠিপত্র পৌঁছতে পায়ে হাঁটতে বা ঘোড়ার পিঠে চড়তে হত। ওই থানার পশুপালক চিনএনগুলি সংবাদদাতাকে তখনকার রাস্তার অবস্থা এভাবে বর্ণনা করেন:

(রে)

"এখানে এমি নামে একটি পাহাড় আছে। সেখান থেকে প্রতিদিন তীব্র বাতাস আসত। পরের দিন রাস্তার ওপর দিয়ে আর হাঁটা যেত না। শীতকালে রাস্তার ওপর যে তুষার জমা হত তার উচ্চতা প্রায় দু'মিটার । তখন গোটা শীতকালে মানুষ পাহাড়ের নিচে যেতে পারত না।"

জিএনসিবিয়ের বয়স যখন ১৮ বছর, তখন তিনি তার বাবার বদলে ওই জেলার ডাকপিয়ন হন। তার বাবা জেলার ওই ডাকপিয়ন ছিলেন। তিনি অবসর নেওয়ার পর জিএনসিবিয়ে তার বাবার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আগে তিনি প্রতি মাসে নির্ধারিত সময় জেলা শহর থেকে চিঠিপত্র আনার জন্য একজন লোককে পাঠাতেন। কিন্তু পরে ওই লোক চিঠিপত্র আনতে অপারগতা প্রকাশ করন। নিরুপায় তিনি হাবাহো জেলার ডাকঘর জিএনসিবিয়েকে ওই থানায় ডাকথলি আনতে পাঠায়। তখন তাকে দুটি ঘোড়া দেওয়া হত। তিনি পালা করে এ দুটি ঘোড়াকে ব্যবহার করতেন। ঠিক সে সময় থেকে জিএনসিরিয়েকে থানার ডাকপিয়ন হন তিনি। বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি নিয়মিত এই 'মাবান ডাকপথে' যাতায়াত করেন।

চিঠি পাঠানোর জন্য প্রতিবার জিএনসিরিয়েকে ১০টি পাহাড় আরোহণ করতে হতো এবং আবহাওয়া খারাপ বলে ১৮০ দিনের মতো মাবান ডাকপথ ট্র্যাফিক জ্যামে থাকে। শীতকালে ব্যাপক তুষার ও বাতাসে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমে যায় হিমাঙ্কের ৪৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড নিচে। পাহাড়ে অনেক নদী এবং শীতকালে নদীর পানি বরফে পরিণত হয় বলে পথ পিচ্ছিল হয়ে যায়। সেখান দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়ের ভিতরে যাওয়া খুবই বিপদজনক।

শীতকালে জিএনসিরিয়েকে পুরু বুট পরতেন এবং একটি ঘোড়া চড়তেন আর আরেকটি ঘোড়া দিয়ে মই টানতেন। যথেষ্ঠ খাবার ও পানি নিয়ে রওনা হতেন তিনি। যদি বেশি তুষারপাত হতো এবং হাঁটা না যেত, তাহলে তিনি কোনো একজন পশুপালকের বাড়িতে এক রাত কাটাতেন এবং যদি পশুপালকের বাসা খুঁজে না পেতেন, তাহলে বাইরে থাকতে বাধ্য হতেন। জিএনসিরিয়েকের একজন সহকর্মী স্মরণ করে বলেন:

(রে)

"একবার জিএনসিরিয়েকে থিয়ে লিয়ে খে নামে একটি জায়গায় যান এবং তিন দিনেও সেখান থেকে ফিরে আসতে পারেন না। আমরা দুজন থিয়ে লিয়ে খে গিয়ে তাকে খুঁজি। জিএনসিরিয়েকে বলেন, ঘোড়া খুব ক্লান্ত ছিল এবং চলতে পারছিল না এবং তিনি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে সারা দিন কিছুই খাননি।"

দিনের পর দিন ৭ বছর ধরে মাবান ডাকপথে নিঃসঙ্গতার সঙ্গে চলেন জিএনসিরিয়েকে। তিনি মোট ২ লাখ কিলোমিটার পথ চলেন এবং ওই সময় একটি চিঠিও হারাননি তিনি। স্থানীয় মানুষের কাছে জিএনসিরিয়েকে তাদের পরিবারের মানুষের মতো।

১৯৮৮ সালের শীতকালে পশুপালক চিনএনসিকুলির ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। জিএনসিরিয়েকে এ পরিস্থিতি দেখে ঘোড়া চড়ে চিনএনসিকুলি ও তার ছেলেকে নিয়ে পাহাড়ের নিচে যান। তবে তুষারের মধ্যে একটি ঘোড়া তিনজনকে নিয়ে যেতে পারে না। তাই জিএনসিরিয়েকে ঘোড়া টেনে সামনে যান এবং নিজের দস্তানাগুলো ছোট ছেলেকে দেন। শীতকাল হলেও জিএনসিরিয়েকে ঘামতে থাকেন। যখন তারা হাসাপাতাল পৌঁছান, তখন ডাক্তার বলেন একদিন দেরি হলে ছেলের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ত। চিনএনসিকুলি বলেন, তিনি ও তার ছেলে সারা জীবনেও জিএনসিরিয়েকে ভুলবেন না।

২০০১ সাল থেকে জিএনসিরিয়েকে মাবান ডাকপথে কাজ করেন না। তবে ২০০৮ সালে অক্টোবরের একদিন জিএনসিরিয়েকে ডাকঘরে একজন ছাত্রকে পাঠানো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতিপত্র দেখেন, যেটিতে বলা হয় এক সপ্তাহের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে হবে। জিএনসিরিয়েকে চিন্তা করেন যে, এ ছাত্র ঠিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাতে পারবে না। তাই তিনি চিঠিটি নিজে ওই ছাত্রের হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অনেক পথ যাওয়ার পর মধ্যরাতে জিএনসিরিয়েকে ওই ছাত্রের বাড়িতে পৌঁছান। এখন ওই ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং একজন গ্রামীণ সরকারি কর্মকর্তা হয়েছেন। তিনি বলেন:

"আমি জিএনসিরিয়েকে অনেক ধন্যবাদ জানাই। তিনি আমার স্বীকৃতিপত্র আমাকে না দিলে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারতাম না। আসলে তিনি শুধু একটি ফোন করতে পারতেন। তবে তখন গ্রীষ্মকাল এবং তখন সব পরিবার কৃষি কাজ করে এবং ডাকঘরে আসতে পারে না। আমার পরিবারের ৬জন ছেলে-মেয়ের স্বীকৃতিপত্র জিএনসিরিয়েকের হাত থেকে পেয়েছে এবং তিনি আমাদের বড় ভাইর মতো আমাদেরকে উত্সাহ দেন।"

এখন জিএনসিরিয়েকের বয়স কম নয়। পরিবেশ ভাল হলেও তিনি পরিশ্রমের কাজ করছেন। বর্তমানে প্রতিদিন জিএনসিরিয়েকে ৪০টি প্রতিষ্ঠানে হাজার খানেক চিঠিপত্র পাঠান। আবহাওয়া যেমনই হোক না কেন, জিএনসিরিয়েকে সব সময় ঠিক সময়ে সবার হাতে চিঠিপত্র পৌঁছে দেন। কখনও কখনও কাজ করার জন্য জিএনসিরিয়েকে রাত ১০টা এমনকি ১১টা পর্যন্ত অফিসে থাকতে হয়। আসলে জিএনসিরিয়েকের পরিবারের অবস্থাও ভাল না। তবে তিনি কখনও ডাকঘরের কাছে নিজের জন্য কোনো দাবি জানাননি।

গত কয়েক বছরে জিএনসিরিয়েকে বেশ কয়েক বার শ্রেষ্ঠ কর্মীর পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি বলেন:

(রে)

"আমার বাবাও এভাবে কাজ করতেন এবং তার বদলে আমি একজন ডাকপিয়ন হই। আমি এ চাকরি পছন্দ করি এবং আমি সবার জন্য মন দিয়ে এ কাজ করা অব্যাহত রাখব।"


1 2
সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
Play
Stop
ওয়েবরেডিও
বিশেষ আয়োজন
অনলাইন জরিপ
লিঙ্ক
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040