Web bengali.cri.cn   
ছে হং চাই ও তার অভিধান
  2015-01-28 13:45:55  cri


ছে হং চাই ১৯৩৬ সালে হে লং চিয়াং প্রদেশের হাই লুন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালে পশ্তু ভাষা শেখার জন্য চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে আফগানিস্তানের কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠায়। ১৯৬৩ সালের জানুয়ারি মাসে স্নাতক হওয়ার পর তিনি পেইচিং ফিরে চীন যোগাযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে তিনি যথাক্রমে চীন আন্তর্জাতিক বেতার এবং পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে চীনা দূতাবাসে কাজ করেন। ১৯৭৮ সালে পশ্তু-চীনা অভিধান সঙ্কলন করার কাজ পান ছে হং চাই। তখন তিনি জানতেন না যে, এ কাজ শেষ করার জন্য তার জীবনের অর্ধেকটা সময় লাগবে। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে ৩৬ বছর পর তার এই অভিধান আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়।

২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারি পেইচিংয়ে চলতি বছরের প্রথম তুষার পড়ে। চীনে শীতকালের তুষার ফসলের জন্য ভালো। এদিন অবসরগ্রপ্ত চে হং চাইর জন্য অসাধারণ এক দিন। বিকেলে চীনে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও পুরাতন প্রকাশনালয় 'দ্য কমার্শিয়াল প্রেস'-এর কয়েকজন কর্মকর্তা চে হং চাইর বাড়িতে আসেন। তারা সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন পশতু-চীনা অভিধানের একটি কপি।

৭৯ বছর বয়সি ছে হং চেইর চুল সব সাদা হয়ে গেছে। নিজের বহু বছরের সাধনার ফসল অভিধানটি দেখে তার চোখ ভরে যায় অশ্রুততে। তিনি সাদা গ্লাভস পড়ে আস্তে আস্তে অভিধানটি খোলেন। তিনি এমনভাবে বইটি নাড়াচাড়া করছিলেন, দেখে মনে হবে প্রথম সন্তানকে কোলে তুলে নিয়েছেন যত্নের সাথে।

'দ্য কমার্শিয়াল প্রেস'-এর কর্মকর্তা চে হং চাইকে জানান, চীনের সবচেয়ে ভাল ছাপাখানায় এ বই মুদ্রিত হয়েছে এবং এতে ব্যবহার করা হয়েছে উন্নতমানের কাগজ।

এদিন, গুরুত্বর্পূণ এ মুহূর্ত স্বচক্ষে দেখার জন্য ছে হং চাইর কয়েকজন ছাত্রছাত্রীও তার বাড়িতে আসেন। লাই তুং ইং কয়েক বছর আগে ছে হং চাইর কাছ থেকে পশতু ভাষা শিখেছেন এবং অভিধান সঙ্কলনের জন্য তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তার নামও অভিধানের লেখকদের নামতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার খবর শুনে লাই তু ইং খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন,

"আমি খুবই খুশি। আমি জানি এ অভিধান রচনার জন্য শিক্ষক ছে অনেক কষ্ট করেছেন এবং তাকে যথেষ্ট সাহায্য না-করতে পারায় আমি সত্যিই দুঃখিত।"

যখন সবাই এ অভিধান নিয়ে ব্যস্ত, তখন একজন মানুষ পাশে দাঁড়িয়ে কিছুই বলেননি। তিনি চে হং চাইর স্ত্রী স্যুই পিং। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর তিনি এ অভিধানটি ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পেলেন। নিজের সন্তানকে স্পর্শ করার মতো করে তিনি বইটির উপর হাত বুলিয়ে দিলেন। দীর্ঘ ৩৬ বছর ধরে তার সমর্থন ছাড়া ছে হং চাই এ অভিধান শেষ করতে পারতেন না, এটা বলাই বাহুল্য।

যখন অভিধান রচনার কাজ শুরু হয় তখন কম্পিউটার জনপ্রিয় হয়নি। অভিধান রচনার কাজ চলতো কাগজে। চে হং চাইকে তখন বিভিন্ন কাজে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হতো। অন্যান্য কাজের ফাঁকে ফাঁকেই চলছিল অভিধান রচনার কাজ। এভাবে এক লাখ টুকরো কাগজে প্রাথমিক লেখার কাজ হলো। তিনি কাগজগুলো একটি আলমারিতে রাখলেন। এ আলমারিও তার সঙ্গে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেত। তবে একবার স্কুল ভবন রূপান্তর প্রক্রিয়ায় কাগজগুলো হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ছে হং চাই ও তার স্ত্রী স্যু পিং হারানো কাগজগুলো খুঁজে দেখতে স্কুলের নির্মাণস্থলে গেলেন। বৃষ্টিতে ভেজা কাগজগুলো তারা একটি একটি করে উদ্ধার করেন। তখনও তারা জানতেন না যে, একদিন এগুলোর সমন্বয়েই প্রকাশিত হবে একটি সুদৃশ অভিধান।

১৯৭৫ সালে 'দ্য কমার্শিয়াল প্রেস' চীনে একটি পশতু-চীনা অভিধান সঙ্কলন করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে তখনকার চীনে পশতু জানা মানুষ ছিল না বললেই চলে। তিন বছর পর 'দ্য কমার্শিয়াল প্রেস'চে হং চাইর সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং এ দায়িত্ব তাকে দেয়ার কথা জানায়। চে হং চাই তখন সিআরআইতে কাজ করছিলেন। প্রস্তাবটি তিনি লুফে নিলেন। ছে হং চাই বলেন, যখন তিনি আফগানিস্তানে লেখাপড়া করছিলেন তখন একটি নীতিবাক্য সবসময় মেনে চলতেন। সেটি হচ্ছে: যত বেশি সম্ভব তত বেশি শিখবো এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য সারাজীবন সাধনা করে যাব। তখন থেকেই দেশের জন্য কিছু করার আকাঙ্খা তার ছিল। ফলে প্রেসের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে তিনি অভিধান রচনাকে জীবনের মূল্য লক্ষ্য স্থির করেন। ছে হং চাই মনে করেন, এ অভিধান সম্পন্ন করতে হবে, কারণ এটা ভবষ্যত বংশধরগণের জন্য হবে তার একটি উপহার।

কিন্তু অভিধান রচনা করা সহজ কাজ নয়। ছে হং চাই বিশ্ববিদ্যালয় ও বেতারে একসঙ্গে কাজ করতেন বলে অভিধান রচনার জন্য খুব কম সময়ই ব্যয় করতে পারতেন। ছে হং চাই বলেন, প্রথম ৪ বছর মন দিয়ে অভিধান রচনার সময় পেয়েছিলেন তিনি। তার পর আর সময় পাননি। তবে ওই ৪ বছরেই তিনি লিখে ফেলেছিলেন এক লাখ পিস কাগজ। ৪ বছর পর কাজ করার জন্য ছে হং চাই পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে চীনা দূতাবাসে গেলেন এবং তারপর অবসর নিলেও, শিক্ষক হিসেবে কাজ অব্যাহত রাখেন। ২০০৯ সালে শিক্ষকতা থেকে অবসর নেয়ার পর তিনি আবার অভিধান রচনার বাকি কাজ শেষ করার সময় পান।

চে হং চাই বলেন, তিনি ছিলেন মাথা গরম মানুষ। কিন্তু অভিধান রচনা শুরু করার পর তার স্বভাবে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ২০০৯ সালের পর থেকেই তিনি কম কথা বলতে শুরু করেন এবং প্রতিদিন মনকে নিয়োজিত রাখেন অভিধান রচনায়। অখণ্ড মনোযোগে একটি কাজ করলে একটু ভুলো মন হওয়া অসম্ভব নয়। হয়তো এ কারণেই ছেই হং চাই এসময় কয়েকটি কুকার পুড়িয়ে ফেলেন।

২০১২ সালের প্রথম দিকে ছে হং চাই এ অভিধান রচনার কাজ শেষ করেন এবং তা প্রকাশের জন্য The Commercial Press-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তথ্যমাধ্যমগুলোও ছে হং চাইর গল্প শুনে অনেক প্রবন্ধ প্রকাশ করে এবং ৩৬ বছর ধরে একটি অভিধান রচনার গল্প সারা চীনে জনপ্রিয় হয়ে যায়।

ছে হং চাই অনেক প্রশংসা পেয়েছেন, তবে তার জন্য এটি একটা সাধারণ ব্যাপার। তিনি বলেন, ৩৬ বছরে তিনি এক একটি পদক্ষেপে, এক একটি শব্দ নিয়ে এ অভিধান শেষ করেছেন। প্রকাশ হল শেষ পদক্ষেপ এবং স্বাভাবিক একটি ফল। প্রশংসা পেলেও তিনি হাওয়ায় উড়তে শুরু করেননি, কারণ তার কাছে এটা ছিল স্রেফ একটি দায়িত্ব যা তিনি পালন করেছেন।

পশতু-চীনা অভিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ৫০ হাজার টার্মস এবং ২৩ লাখ শব্দ। এটি চীনে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত পশতু-চীনা অভিধান।

অভিধানটি প্রকাশের পর অনেকেই এটা সংগ্রহ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাদের অনেক টেলিফোন প্রকাশক রিসিভ করেছেন। অনেকে আছেন, যারা পশতু ভাষা শিখতে চান না, কিন্তু অভিধানটি সংগ্রহে রাখতে ইচ্ছুক। কারণ, তারা এর রচনার ইতিহাস শুনে মুগ্ধ হয়েছেন।

কিছু দিন আগে, চীন-আফগানিস্তান কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৬০তম বার্ষিকী উপলক্ষে ২০ জানুয়ারি কাবুলে অনুষ্ঠিত হয় একটি অনুষ্ঠান। সে অনুষ্ঠানে ছে হং চাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি আফগান প্রেসিডেন্টের হাত থেকে একটি পদক গ্রহণ করেন। তিনি তখন তার রচিত অভিধানের একটি কপি আফগান প্রেসিডেন্টকে উপহার দেন।

যদিও ছে হং চাই বিখ্যাত মানুষ হতে চাননি, কিন্তু তিনি চীনে বিখ্যাত হয়েছেন। তার গল্প চীনের অনেককে অনুপ্রাণিত করেছে এবং ভবিষ্যতেও করতে থাকবে। তার পরিশ্রমের ফলে অনেক চীনা পশতু ভাষা শিখতে আগ্রহী হবে বলেও আশা করা হচ্ছে।

ছে হং চাইর গল্প শুনে আমি ভাবছি, পশতুর মতো বাংলাও চীনে অপরিচিত একটি ভাষা। তবে চীনের এ ভাষার প্রচার ও প্রসারের জন্য অনেক বিশেষজ্ঞ এবং আমার সহকর্মীরা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন বা চালাচ্ছেন। আমিও আশা করি, একদিন চীনে পূর্ণাঙ্গ একটি বাংলা-চীনা অভিধান প্রকাশিত হবে এবং সে কাজে আমি একটি ভূমিকা পালন করতে পারবো।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
Play
Stop
ওয়েবরেডিও
বিশেষ আয়োজন
অনলাইন জরিপ
লিঙ্ক
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040