পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রস্তাবিত 'একবিংশ শতাব্দের সামুদ্রিক রেশমপথ' প্রতিষ্ঠিত হলে সবার আগে উপকৃত হবে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার। এদিকে, দক্ষিণ চীনের গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলো প্রস্তাবিত রেশমপথকে বিবেচনায় রেখে নতুন উন্নয়ন-লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কারণ, একবিংশ শতাব্দের সামুদ্রিক রেশমপথ নতুন নতুন নৌরুট চালু হতে সাহায্য করবে এবং বন্দরগুলো থেকে বিভিন্ন দেশের পণ্য স্থানান্তর ব্যয়ও কমে যাবে।
ভোরবেলায় প্রায় গোটা কুয়াংচৌ শহর যখন হালকা কুয়াশার চাদরে গা মুড়ি দিয়ে গভীর ঘুমে অচেতন, ঠিক তখন এ শহরেরই লোংশুয়ান দ্বীপের নানশা বন্দর কর্মমুখর, ব্যস্ত। জাহাজঘাটায়কন্টেনার ওঠানামা চলছে। এখানকার দশটি জাহাজঘাটে ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের মালবাহী জাহাজ নোঙর করা থাকে। আরও ছয়টি নতুন জাহাজঘাট নির্মিত হচ্ছে। চলতি বছরের শেষ দিকে নির্মাণকাজ সম্পন্ন হবে। অন্যদিকে আগামী বছর শুরু হবে আরও কিছু জাহাজাঘাটা নির্মাণকাজ।
নানশা বন্দর কন্টেনার জাহাজঘাটা লিমিটেড কোম্পানির ব্যবস্থাপক ফান চিয়ান ছিয়াং বলেন, "এ বছরের মে মাসে কুয়াংতোং অবাধ বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পর নানশা বন্দর ছয়টি নতুন গমনপথ খুলেছে। এগুলো প্রধানত 'এক অঞ্চল, এক পথ'-সংলগ্ন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যাতায়াতের গমনপথ। এ বন্দরের নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হলে ১৬টি জাহাজঘাটের তটরেখার দৈর্ঘ্য হবে ৫৮০০ মিটার। তখন বন্দরের বার্ষিক মাল বোঝাই ও খালাশের পরিমাণ দাঁড়াবে ২ কোটি কন্টেনারে।"
'এক অঞ্চল, এক পথ' প্রস্তাবের ফলে এখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ছে। নানশা বন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ নির্মাণসামগ্রী ও সরঞ্জাম রপ্তানির পরিমাণও বেড়েছে। এর পাশাপাশি কুয়াংতোং অবাধ বাণিজ্য অঞ্চলের 'কুয়াংতোং-হংকং-ম্যাকাও সহযোগিতা গভীরতর করা'-র লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হবার পর নানশা বন্দর থেকেহংকং ও ম্যাকাওয়ে পণ্য স্থানান্তরের পরিমাণ বেড়েছে।
ফান চিয়ান ছিয়াং বলেন,"নানশা বন্দরের ক্লায়েন্ট সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। নতুন গমনপথগুলো তাদের জন্যই খুলতে হয়েছে। অবাধ বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠা অবশ্যই কিছু নতুন সুযোগ আনবে এবং উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে। চীন সরকারের নীতি ক্লায়েন্টদের জন্য আকর্ষণীয়।"
চুহাই বন্দর দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের কুইচৌ প্রদেশের ছিয়াননান বিভাগ আর পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দরের সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এ থেকে দক্ষিণ চীনের গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলোর সক্রিয়ভাবে 'এক অঞ্চল, এক পথ' নির্মাণকাজে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রতিফলিত হয়েছে।
এ বছরের এপ্রিলে চুহাই বন্দর আর গোয়াদার বন্দর 'সিস্টার পোর্ট' চুক্তি স্বাক্ষর করে। সহযোগিতার আওতার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে গমনপথ খোলা, পণ্য স্থানান্তর অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, অবাধ বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। চুহাই বন্দর হোল্ডিং গ্রুপের বোর্ড চেয়ারম্যান ও হুই শেং বলেন, "আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে, দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের পণ্যগুলো চুহাই বন্দরে জড়ো করা। আমরা গোয়াদার বন্দর ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোতে যাওয়ার গমনপথ খুলে, সেগুলোর মাধ্যমে সেসব পণ্যমধ্যপ্রাচ্যে পৌছে দেব। এভাবে সামুদ্রিক রেশমপথ প্রতিষ্ঠিত হবে। তা ছাড়া, দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের ভাল পণ্যগুলো চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের রেলপথেগোয়াদার বন্দর দিয়ে অন্য দেশে পাঠাবো।"
তিনি বললেন, চুহাই বন্দর থেকে চার দিকে যাওয়া যায়। বিশেষ করে গোয়াদার বন্দরের সঙ্গে সহযোগিতার ফলে বিভিন্ন দেশের শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পণ্য স্থানান্তরের একটি সস্তা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
গোয়াদার বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান রাজিক দুর্রানি বাণিজ্য ক্ষেত্রে চীনের পরিকল্পনার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, "চীনের নৌ-পরিবহন ব্যবস্থা ভাল, তার নিজের পণ্যসামগ্রীও আছে। চীন পাকিস্তানে কিছু অবকাঠামো নির্মাণকাজ করতে পারে এবং দেশের পশ্চিমাঞ্চলে পণ্য স্থানান্তর করতে পারে। চীন গোয়াদার বন্দরের মাধ্যমে আফগানিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন বজায় রাখতে পারে। কারণ, আফগানিস্তান হচ্ছে স্থলবেষ্টিত দেশ। সে দেশের অনেক পণ্য গোয়াদার বন্দরের মাধ্যমে অন্যান্য মধ্য-এশীয় দেশে পাঠাতে হয়। তাদের পণ্য দরকার, বাণিজ্য উন্নয়নও দরকার।"
চুহাই বন্দর আর গোয়াদার বন্দরের সুষ্ঠু সহযোগিতার ফলে চুহাই ও গোয়াদার শহরের মধ্যে 'মৈত্রী নগর'-এর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ও হুই মেং বলেন, "আমাদের সহযোগিতার ভিত্তি হচ্ছে অভিন্ন স্বার্থ। এটা দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্প নয়, বা একতরফা দেওয়ার বিষয়ও নয়। এটা হচ্ছে অভিন্ন স্বার্থভিত্তিক সহযোগিতা।"
'এক অঞ্চল, এক পথ' প্রস্তাবের কারণে দক্ষিণ চীনের অনেক বন্দর 'আন্তর্জাতিক সংযোগস্থল'-এ রূপান্তরিত হওয়াকে উন্নয়নের নতুন লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে নির্ধারণ করেছে। বিভিন্ন অঞ্চলের সরকার সক্রিয়ভাবে শিল্প্র-তিষ্ঠানগুলোর উচ্চ চাহিদা মেটানোর প্রচেষ্টাও চালাচ্ছে।
শেনচেন শহরের ছিয়ান হাই গভীর সমুদ্রবন্দর আধুনিক সেবাশিল্প সহযোগিতা অঞ্চলের ব্যবস্থাপনা ব্যুরোর মুখপাত্র ওয়াং চিন সিয়া বলেন, "আন্তর্জাতিক সংযোগস্থল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চাইলে, এতদঞ্চলের বন্দরগুলোর রূপান্তর ও উন্নয়ন অপরিহার্য।"
বস্তুত বর্তমানেচুহাই, নানশা, শেনচেনের ছিয়ানহুইয়ে পুরো উদ্যমে চলছে অবকাঠামো উন্নয়ন ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কাজ। আশা করা হচ্ছে, একবিংশ শতাব্দের সামুদ্রিক রেশমপথ প্রতিষ্ঠায় এসব অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। (ইয়ু/আলিম)