সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের অর্থনীতির রূপান্তরের সাথে সাথে বিদেশে দেশটির শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মতত্পরতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়। ২০১৩ সালে চীনের উত্থাপিত 'রেশমপথ অর্থনৈতিক অঞ্চল' আর 'একবিংশ শতাব্দীর সামুদ্রিক রেশমপথ' প্রস্তাব বিদেশে চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য যেমন নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে, তেমনি রেশমপথসংলগ্ন দেশগুলোর উন্নয়নের ক্ষেত্রেও যোগ করেছে নতুন মাত্রা।
২০১৪ সালে ছিরুই গাড়ির রফতানির পরিমাণ ছিলচীনের মোট গাড়ি রফতানির ২৭ শতাংশ। 'এক অঞ্চল, এক পথ'-সংলগ্ন ৬০টিরও বেশি দেশের মধ্যে ৪৯টি দেশেই ছিরুই গাড়ি রফতানি করে। ২০১৫ সালের রফতানি পরিকল্পনা প্রসঙ্গে ছিরুই গাড়ি কোম্পানির বোর্ড চেয়ারম্যান ইন থোং ইউয়ান বলেন, "চলতি বছর আমরা ১ লাখ ৩৬ হাজার গাড়ি রফতানির পরিকল্পনা করেছি। মূলত মধ্য-এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য আর দক্ষিণ আমেরিকাসহ 'এক অঞ্চল, এক পথ'-সংশ্লিষ্ট দেশগুলো আমাদের লক্ষ্য। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার প্রতিটি গাড়ি কোম্পানির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।"
২০০৯ সালে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে বিশ্বের বৃহত্তম গাড়ি-বাজারে পরিণত হয়। পাশাপাশি চীনের গাড়ি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোও বিদেশে নিজেদের বাজার বিস্তৃত করে।
চীনের গাড়িশিল্প বিষয়ক বিশেষজ্ঞ লি টিয়ে চাং বলেন, "দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য, এমনকি পূর্ব ইউরোপও গাড়িশিল্পে তুলনামূলকভাবে অনুন্নত। এ বাজার বিশাল। আমাদের সুযোগ আছে। উত্পাদনের সামর্থ্য ও পরিমাণ বাড়াতে হবে। কেবল অভ্যন্তরীণ বাজারের ওপর নজর দেয়া চলবে না।"
চীনের কিছু গাড়ি শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিদেশের নামকরা গাড়ি কোম্পানি কিনে নিয়েছে ইতোমধ্যেই। ২০১০ সালের আগস্টে চীনের চিলি হোল্ডিং গ্রুপ আনুষ্ঠানিকভাবে ফোর্ড মোটর কোম্পানির অধীনস্থ ভলভোর সব শেয়ার কিনে নেয়।
গত ১৪ জুলাই চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ তত্ত্বাবধান ব্যবস্থাপনা কমিটিশিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য 'এক অঞ্চল, এক পথ'-সংক্রান্ত রোডম্যাপ প্রকাশ করে। রাষ্ট্রীয় উপাত্ত অনুসারে, ২০১৪ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় সম্পদ তত্ত্বাবধান ব্যবস্থাপনা কমিটির অধীনস্থ ১১০টি কেন্দ্রীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০৭টি বিদেশে মোট ৮৫১৫টি শাখা খুলেছে। এসব শাখা বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। অন্যদিকে, ৮০টিরও বেশি কেন্দ্রীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান 'এক অঞ্চল, এক পথ'-সংলগ্ন দেশে শাখা স্থাপন করেছে।
চলতি বছরের এপ্রিলে চায়না পাওয়ার কনস্ট্রাকশন গ্রুপ লিমিটেডপাকিস্তানের সাথে কাসিম বন্দরকয়লা বিদ্যুত্কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রকল্পচুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এ প্রকল্প চায়না পাওয়া গ্রুপ আর কাতার বিনিয়োগ ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হবে। কেন্দ্রটির বার্ষিক বিদ্যুত্ উত্পাদন ক্ষমতা হবে ৯৫০ কোটি কিলোওয়াট ঘন্টা। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০১৭ সালের শেষ দিকে এ বিদ্যুত্কেন্দ্র আনুষ্ঠানিকভাবে বিদ্যুত্ উত্পাদন শুরু করবে। চীনের জলবিদ্যুত্ ও জলসেচবিষয়ক সপ্তম প্রকল্প ব্যুরোর বিদেশ বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা কু সি গো বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদেশে এ কোম্পানির তত্পরতা বেড়েছে। কোম্পানির বিনিয়োগের ক্ষেত্রও সম্প্রসারিত হয়েছে।
উ সি কুও বলেন, "গেল দশ বছরে আমরা বিদেশে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। প্রকল্প দু'টির আর্থিক মূল্য প্রায় ১০ কোটি মার্কিন ডলার। অন্যদিকে, গত দু'বছর আমরা বিদেশে পাঁচটি নতুন প্রকল্প পেয়েছি। এগুলোর মোট মূল্য প্রায় ৬০ কোটি মার্কিন ডলার।"
গত ২৮ জুন থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত চীনের প্রধানমন্ত্রী লি খ্য ছিয়াং ব্রাসেলসে সপ্তদশ চীন-ই.ইউ সম্মেলনে অংশ নেন এবং বেলজিয়াম ও ফ্রান্স সফর করেন। ব্রাসেলসে লি খ্য ছিয়াং বলেন, "চীন-ইউরোপ সম্পর্ক, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক কেবল কেনাকাটার সম্পর্ক নয়। দু'পক্ষের উচিত পারস্পরিক বিনিয়োগ তথা যৌথ বিনিয়োগবিস্তৃত করা। চীন সক্রিয়ভাবে ইউরোপের বিনিয়োগ পরিকল্পনায় অংশ নিতে চায়।"
গত বছরের নভেম্বরে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জা-ক্লদ ইয়ুঙ্কা ৩১৫ বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এ পরিকল্পনার মধ্যে ২০০০টিরও বেশি প্রকল্প রয়েছে।
শাংহাই আন্তর্জাতিকবিষয়ক গবেষণালয়ের ইউরোপ গবেষণাকেন্দ্রের পরিচালক ইয়ে চিয়াং বলেন, "এক অঞ্চল, এক পথ-এর গন্তব্যস্থল হচ্ছে ইউরোপ। দু'পক্ষের উচিত আর্থিক ক্ষেত্রের সহযোগিতা জোরদার করা, অর্থাত্ ইউরোপ ও এশিয়ার আন্তঃযোগাযোগ আর অভিন্ন উন্নয়নের গতি বাড়ানো। এ ক্ষেত্রে এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক এবং ইয়ুঙ্কার পরিকল্পনার মিল আছে। চীনের প্রধানমন্ত্রীর সফর আর ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের বৈঠক এ প্রকল্পগুলোকে বাস্তবায়ানের পর্যায়ে নিয়ে যাবে।"
গত বছরের মার্চে চীন ও ইউরোপ এক যৌথ ঘোষণায় চীনের 'রেশমপথ অর্থনৈতিক অঞ্চল' প্রস্তাব এবং ই.ইউর নীতির মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
চীনের সমাজবিজ্ঞান একাডেমির আন্তর্জাতিক বিভাগের উপ-প্রধান চৌ হোং বলেন, "আমাদের এক অঞ্চল, এক পথ কৌশলগত পরিকল্পনা এবং ই.ইউ'র ইয়ুঙ্কা পরিকল্পনাসমন্বিত হতে পারে। অর্থাত্ আমরা ইউরোপের উন্নয়নে অংশ নিতে পারি এবং ইউরোপ চীনের 'এক অঞ্চল, এক পথ' প্রতিষ্ঠায় অংশ নিতে পারে। ই.ইউর অনেক দেশ এশিয়ার অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকে অংশ নিয়েছে। এ দুটি বড় অর্থনৈতিক সত্তা আরও ভালোভাবে সংযুক্ত হয়ে পরস্পরের শক্তিশালী দিকগুলো কাজে লাগাতে পারে।"
সম্প্রতি ইয়ুঙ্কা চীনের তথ্যমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে বলেন, ই.ইউ আর চীন বহু ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারে। ইউরোপের পূর্বাঞ্চলের সড়কজাল আর রেশমপথের পশ্চিম দিক পরস্পরসংলগ্ন। চীনের 'এক অঞ্চল, এক পথ' প্রস্তাব আর ই.ইউর ইয়ুঙ্কা বিনিয়োগ পরিকল্পনা সংযুক্ত করা হবে পরস্পরের শক্তিশালী দিকগুলো কাজে লাগানোর একটি উত্তম উপায়।
বস্তুত, বর্তমানে ইউরোপে চীনের বিনিয়োগ দ্রুত বাড়ছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রও ধারাবাহিকভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ইউরোপে চীনের অ-আর্থিক খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ৪.২১ কোটি মার্কিন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৬৭.৮ শতাংশ বেশি। জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো 'এক অঞ্চল, এক পথ'-সংলগ্ন ৪৮টি দেশ ও অঞ্চলে সরাসরি বিনিয়োগ করে ৪৮৬ কোটি মার্কিন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩.৭ শতাংশ বেশি। এদিকে, চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো 'এক অঞ্চল, এক পথ'-সংলগ্ন ৫৯টি দেশ ও অঞ্চলের সাথে মোট ২৫.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের নতুন প্রকল্পচুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৯.১ শতাংশ বেশি।
মোদ্দাকথা, আর্থনীতিক ক্ষেত্রে চীন-ইউরোপ সহযোগিতা দিন দিন বাড়ছে এবং 'এক অঞ্চল, এক পথ'-এর আওতায় ভবিষ্যতে তা আরও জোরদার হবে, এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। (ইয়ু/আলিম)
| ||||