গ্রীষ্মকালীন দাভোস ফোরাম, ২০১৫-এর বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধন হয় গত ১০ সেপ্টেম্বর চীনের তালিয়ানে। চীনের প্রধানমন্ত্রী লি খ্য ছিয়াং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, তার দেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মূল লক্ষ্য অর্জনে এবং ভবিষ্যতের জন্য টেকসই উন্নয়নের মজবুত ভিত্তি গড়ে তুলতে সচেষ্ট। তিনি আরও বলেন, চীনের অর্থনীতি কেবল দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত তা নয়, যে-কোনো ঝুঁকি বা সমস্যা মোকাবিলার ক্ষমতাও এর আছে।
বর্তমান বিশ্ব ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছে আর্থনীতিক সংকট। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব অর্থনীতির শক্তি-সামর্থ্যও সীমিত। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তাই বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধির হার কমিয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছে। আবার পাশাপাশি শোনা যাচ্ছে চীনের অর্থনীতি নিয়ে বিদেশিদের উদ্বেগের কথাও। এমনি এক প্রেক্ষাপটে দাভোস ফোরামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মূল ভাষণ দেন চীনের প্রধানমন্ত্রী লি খ্য ছিয়াং। তিনি তার ভাষণের শুরুতেই বলেন, "আমি আপনাদের জানাতে চাই, চীনের অর্থনীতি বর্তমানে মন্থর গতিতে সামনে এগুচ্ছে এবং এই প্রবণতা সন্তোষজনক। অবশ্য অর্থনীতির সামনে চ্যালেঞ্জ নেই, তা নয়। তবে সার্বিকভাবে চ্যালেঞ্জের চেয়ে সুযোগই বেশি। আমরা চলতি বছর চীনের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মূল লক্ষ্য অর্জনে এবং ভবিষ্যতের জন্য টেকসই উন্নয়নের মজবুত ভিত্তি স্থাপন করতে চাই।"
চীনের প্রধানমন্ত্রী লি খ্য ছিয়াং
লি খ্য ছিয়াং জানান, চীনের অর্থনৈতিক কাঠামো সুবিন্যস্ত করার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। দেশের জিডিপিতে সেবাশিল্পের অবদান প্রায় অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে। আর অর্জিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভোগের অবদান ৬০ শতাংশ। এ ছাড়া, উচ্চ প্রযুক্তি শিল্পে দ্রুত উন্নতি ঘটছে। তথ্য, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ও পর্যটনসহ নানা খাতে ভোগ বেড়েছে। জ্বালানি সাশ্রয়, পরিবেশ সুরক্ষা, সবুজ অর্থনীতি খাতে উন্নয়ন ঘটছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। চীনের অর্থনীতি অনেক সমস্যা মোকাবিলা করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ভাষণে লি খ্য ছিয়াং চলতি বছর চীন সরকারের নেওয়া সংস্কার কার্যক্রম ব্যাখ্যা করেন। তিনি জানান, শুল্ক, বিনিয়োগ ও অর্থ সংগ্রহ, পণ্যের দামসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। তিনি বলেন, "নিরন্তরভাবে সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার যে সংকল্প আমাদের আছে, তা পরিবর্তন হবে না; সংস্কারের গতিও মন্থর হবে না।"
গত বছরের গ্রীষ্মকালীন দাভোস ফোরামে লি খ্য ছিয়াং 'গণ ব্যবসা ও উদ্ভাবন'-এর কথা বলেছিলেন। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল গোটা চীনেই। সে কথা স্মরণ করে লি খ্য ছিয়াং বলেন, ব্যবসা ও উদ্ভাবন হচ্ছে কাঠামোগত সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ বিষয়দু'টি উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির অন্যতম উপায়। তিনি জোর দিয়ে বলেন, "আমি ব্যবসা ও উদ্ভাবনের ওপর একটু বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ, মানুষের সৃষ্টিক্ষমতা অসীম। চীনাদের তথা মানবজাতির বুদ্ধিও অসীম। 'গণ ব্যবসা ও উদ্ভাবন'-এর ধারণা থেকে উপকৃত হতে চাইলে সার্বিকভাবে জনপ্রিয় পণ্য ও সেবার সরবরাহ বাড়াতে হবে। এর জন্য কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। চীন সরকার এ খাতে সামাজিক পুঁজি ও বিদেশি পুঁজিকে স্বাগত জানায়।"
বৈশ্বিক অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে ও উন্নয়নের নতুন চালিকাশক্তি খুঁজে বের করা প্রসঙ্গে লি খ্য ছিয়াং চীনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব তুলে ধরেন। তিনি এ প্রসঙ্গে 'এক অঞ্চল, এক পথ' প্রতিষ্ঠা করা, আন্তর্জাতিক উত্পাদনক্ষমতা বাড়াতে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো এবং বাজারকে আরও উন্মুক্ত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, এসব লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বিভিন্ন দেশে বিদ্যমান সুযোগুলোর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং ভারসাম্যপূর্ণ ও সুবিধাজনক আন্তর্জাতিক শিল্প চেইন গড়ে তুলতে হবে।
লি খ্য ছিয়াং বলেন, "উত্পাদনক্ষমতা বাড়াতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের জন্য লাভজনক হবে। বিষয়টি শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো বুঝতে পারছে। আমরা এক্ষেত্রে সেতুর ভূমিকা পালন করতে চাই। আমরা শিল্পোন্নত দেশ থেকে আরও বেশি করে উন্নত মানের প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম কিনবো। এগুলো চীনের মধ্যম পর্যায়ের প্রযুক্তি ও সরঞ্জামের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর চাহিদা মেটাতে পারবে।"
দাভোস ফোরামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যখন চীনের প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন সেখানে ৯০টি দেশের ১৭০০ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী লি'র ভাষণের সময় প্রতিনিধিরা বার বার করতালি দিয়ে তার কথা ও মন্তব্যের প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করেন।
বিশ্ব অর্থনীতি ফোরামের নির্বাহী চেয়ারম্যান ক্লজ শোয়াব তার ভাষণে বলেন, প্রধানমন্ত্রী লি'র ভাষণে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তিনি জানিয়েছেন, চীনের অর্থনীতির সুষ্ঠু ভিত্তি আছে এবং বরাবরের মতই চীন বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাবে। তিনি বলেন, "প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য আছে। তথ্যটি হচ্ছে: চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বর্তমান প্রবণতা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য কোনো সমস্যা নয়, বরং আস্থা ও সুযোগের উত্স। তিনি বিশেষভাবে গণ ব্যবসা ও উদ্ভাবনের কথা বলেছেন। চীনের অর্থনীতিতে নমনীয়তা আছে, এর সুষ্ঠু ভিত্তি আছে এবং আছে সংস্কারের ক্ষেত্রে সরকারের দৃঢ় সংকল্প। এটা কোনো অন্ধ আশাবাদ নয়, এর বাস্তব ভিত্তি আছে।" (ইয়ু/আলিম)
| ||||