1016yin
|
শ্রীলংকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় নগর গাল্লে হচ্ছে একটি ঐতিহ্যবাহী শহর। পাশাপাশি দেশটির চারটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শহরের অন্যতম। ১৬ শতাব্দী থেকে ওই অঞ্চলে পর পর পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস ও ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল। ১৯৪৮ সালে স্বাধীন হয় দেশটি। কিন্তু ইউরোপীয়রা শ্রীলংকায় উপনিবেশ গড়ার আগেই মূল্যবান এ স্থানটি সামুদ্রিক সিল্ক রোডের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বিভিন্ন দেশের জাহাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বন্দরে পরিণত হয়।
ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, ১৪০৫ থেকে ১৪৩৩ সাল পর্যন্ত মিং রাজবংশের সময়ের বিখ্যাত নাবিক জেং হো'র সাত বার সমুদ্রযাত্রায় ৫ বার শ্রীলংকা সফর করেছিলেন। তৃতীয়বার সমুদ্রযাত্রায় তিনি গাল্লেতে গিয়েছিলেন। বর্তমানে গাল্লে প্রাচীন নগরে অবস্থিত জাতীয় জাদুঘরে 'শ্রীলংকা-চীন ঐতিহ্যবাহী মৈত্রী' প্রদর্শনী হল আছে। ছবি, মডেল ও ভিডিওসহ বিভিন্ন রূপের মাধ্যমে ৬ শতাধিক বছর আগে জেং হো'র নৌবহর প্রাচীন সিলন সফরের নিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে সেখানে।
প্রদর্শনী হলে প্রবেশ করলে প্রথম দেখা যাবে একটি জেং হো'র পূর্ণদৈর্ঘ্যের ভাস্কর্য। সূর্যাস্তের সময় গাল্লে সমুদ্রতীরের পটভূমিতে সে ভাস্কর্যটি রাখা হয়েছে।
ভাস্কর্যের পেছনে ইলেকট্রনিক ডিসপ্লেতে সিংহলী ভাষার জেং হো সমুদ্রযাত্রার প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে। চারদিকের ডিসপ্লে উইন্ডোতে চীনের প্রাচীনকালের নীল ও সাদা চীনামাটির বাসন এবং প্রাচীন ধাতব মুদ্রা প্রদর্শিত হয়। জাদুঘরের কর্মী আয়োনা দেসানায়াকে বলেন,
ইতিহাসগ্রন্থের তথ্য অনুযায়ী, ৩ শতাধিক জাহাজ এবং বিপুল কর্মকর্তা ও সেনা নিয়ে জেং হো'র নৌবহর গঠিত হয়। গাল্লেতে আসার সময় জেং হো সেখানে তিনটি ভাষার একটি পাথরের ফলক স্থাপন করেছিলেন। পাথর ফলক, প্রাচীন ধাতব মুদ্রা এবং অন্যান্য পুরাকীর্তি নিদর্শন চীন ও শ্রীলংকার মধ্যে বাণিজ্যিক আদান-প্রদানের ইতিহাসকে প্রমাণ করে।
আয়োনার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, জেং হো'র স্থাপিত পাথর ফলকটি প্রথম দিকে গাল্লের একটি মন্দিরে ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা হারিয়ে গেছে। ১৯১১ সালে রাস্তা মেরামত করার সময় ব্রিটিশ প্রকৌশলী এইচ এফ থমালিন সেটি আবিষ্কার করেছিলেন। শ্রীলংকা স্বাধীন হবার পর পাথরের ফলকটি রাজধানী কলোম্বোর জাতীয় জাদুঘরে পাঠানো হয়।
আয়োনার সরবরাহ তথ্য অনুযায়ী, সংবাদদাতা কলোম্বোয় ১৪৪.৫ সেন্টিমিটার উঁচু, ৭৬.৫ সেন্টিমিটার প্রস্থ এবং ১২.৫ সেন্টিমিটার স্থূল রহস্যময় পাথরের ফলকটি দেখেন। জাদুঘরের শিক্ষা উন্নয়ন কর্মকর্তা সানজিওয়ানি উইদিয়ারাটনে সংবাদদাতাকে বলেছেন, পাথর ফলকটির পূর্ণ নাম হলো জেং হো 'এপিগ্রাফিয়া জিলানিকা'। ১৪০৯ সালে জেং হো সমুদ্রযাত্রার আগে নানচিংয়ে খোদাই করে ফলকটি জাহাজে করে প্রাচীন সিলনে নিয়ে যান এবং সেখানে স্থাপন করেন। পাথরের ফলকটিতে চীনা, তামিল এবং পারসিক তিনটি ভাষা খোদাই থাকায় সেটিকে 'তিন ভাষার ফলক' বলেও উল্লেখ করা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন বাইরে থাকার কারণে এর আংশিক লিপির বেশ ক্ষতি হয়েছে।
সানজিওয়ানি ফলকের লিপির বিষয়বস্তু নিয়ে সংবাদদাতাদের জানান, এসব ভাষা ও বিষয়বস্তু পুরোপুরিভাবে প্রাচীন সামুদ্রিক সিল্ক রোডের বহুমুখী বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছে। তিনি বলেন,
গবেষণা অনুযায়ী, চীনা ভাষার বিষয়বস্তু হলো বুদ্ধের প্রতি মিং রাজবংশের সম্রাট ইয়োং লে'র প্রশংসা এবং দেবতার প্রতি উত্সর্গের ধারণা। তামিল ও পারসিক ভাষায় যথাক্রমে হিন্দু ধর্মের ঋষি বিষ্ণু এবং ইসলাম ধর্মের আল্লাহ'র প্রতি প্রশংসা করা হয়েছে। তখন প্রধান ব্যবসায়ীরা আরব থেকে আসতেন। সুতরাং ফলক লিপিতে আরবি ভাষাও আছে। পাশাপাশি প্রাচীন সিলনের অধিকাংশ ব্যবসায়ী ছিলেন তামিল এবং তারা তামিল ভাষা ব্যবহার করতেন। চীনা ভাষা তখনকার চীন ও শ্রীলংকার মধ্যে সিল্ক রোডের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগকে প্রতিফলিত করেছে।
সানজিওয়ানি বলেছেন, 'জেং হো এপিগ্রাফিয়া জিলানিকা'র মতো একই পাথর ফলকে তিন ধরনের ভাষায় তিনটি ধর্মের প্রশংসা করার বিষয়টি শ্রীলংকার ইতিহাসে খুবই বিরল একটি বিষয়। এর আবিষ্কার ঐতিহাসিক গবেষণার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন,
পাথর ফলকটি হলো প্রাচীন সামুদ্রিক সিল্ক রোডের গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি নিদর্শন। পাশাপাশি চীন-শ্রীলংকা যোগাযোগ স্বচক্ষে দেখার মূল্যবান বাস্তব ইতিহাসের অন্যতম উপাদান। আমার জানা মতে, চীনে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক সামুদ্রিক সিল্ক রোডের সঙ্গে সম্পর্কিত পাথর ফলক আবিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু শ্রীলংকায় আবিষ্কৃত এবং জাদুঘরে সংগ্রহীত 'তিনটি ভাষা ফলক' শুধুমাত্র একটি। এটা হলো চীন-শ্রীলংকা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার।
জাদুঘরের তথ্য অনুযায়ী, 'জং হো এপিগ্রাফিয়া জিলানিকা' শ্রীলংকার জাতীয় জাদুঘরের মূল্যবান সংগ্রহগুলোর অন্যতম বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শ্রীলংকার পর্যটন শিল্প উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে শুধু স্থানীয় পর্যটক নয়, বরং আরো বেশি চীনা পর্যটক সেখানে পরিদর্শনে যান। প্রাচীন সামুদ্রিক সিল্ক রোডের সাক্ষ্য বহনকারী শতাধিক বছরের পুরানো পাথরের ফলকটি অব্যাহতভাবে ২১ শতাব্দীর সামুদ্রিক সিল্ক রোডের চীন-শ্রীলংকা মৈত্রীকে বাস্তবে তুলে এনেছে।
প্রেমা/তৌহিদ