গত সপ্তাহে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঙ্গনে প্রধান আলোচ্য ছিল ট্রান্সপ্যাসিফিক পার্টনারশিপ বা টিপিপি চুক্তি স্বাক্ষর এবং এর ফলে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের বাজার হারানোর আশঙ্কার বিষয়টি। এরইমধ্যে বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন আন্তর্জাতিক মানিলন্ডারিং বিশেষজ্ঞ দল। আর অর্থনীতিতে বাংলাদেশের ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যয় ব্যক্ত করাও অন্যতম আলোচ্য ছিল গত সপ্তাহে।
৬ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেকের সভায় শেখ হাসিনা বলেন, সকলে আত্মবিশ্বাস নিয়ে একযোগে কাজ করলে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন কঠিন কোনো কাজ নয়। কাঙ্খিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে মন্ত্রণালয়গুলোকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে বলেন প্রধানমন্ত্রী। সরকারের ধারাবাহিকতা থাকলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনও সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। বিশ্বে বাংলাদেশকে মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে তার সরকার কাজ করছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। বৈঠক শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল জানান, দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে জাতীয় ডাটা সেন্টার প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এটিসহ ২ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট চারটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয় একেনেকে।
এদিকে, মুদ্রাপাচার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন বন্ধে বাংলাদেশের নেওয়া পদক্ষেপ সরজমিনে দেখতে গত সপ্তাহে ঢাকা সফর করে আন্তর্জাতিক মানিলন্ডারিং বিশেষজ্ঞ দল এশিয়া-প্যাসিফিক গ্রুপ বা এপিজি। ১১ সেপ্টেম্বর প্রতিনিধি দলটি বৈঠক করে অর্থপ্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নানের সঙ্গে। প্রায় দুঘণ্টার বৈঠকে প্রতিনিধি দলটিকে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে অবহিত করেন প্রতিমন্ত্রী। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে সন্তোষ প্রকাশ করে এপিজি প্রতিনিধিদল। এবিষয়ে এখনো যে সব ঘাটতি রয়ে গেছে তা অচিরেই পূরণ করা হবে বলে জানান অর্থপ্রতিমন্ত্রী।
একই দিন সেগুন বাগিচায় দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে এপিজি প্রতিনিধিদল। বৈঠককে অর্থপাচার সংক্রান্ত দুদকের অনুসন্ধান ও মামলাসহ নানা বিষয়ে মতবিনিময় হয় তাদের সঙ্গে। এছাড়া, মুদ্রাপাচার বন্ধে গোয়েন্দা সংস্থা সিআইডি, পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক, আইন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও বৈঠক করে প্রতিনিধিদলটি।
গত সপ্তাহে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রধান আলোচ্য ছিল ইতিহাসের বৃহত্তম আঞ্চলিক চুক্তি ট্রান্সপ্যাসিফিক পার্টনারশিপ বা টিপিপি চুক্তি। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাসহ ১১টি দেশে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পাবে তৈরি পোশাকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম। এতে বাংলাদেশ বাজার হারাতে পারে এমন আশঙ্কার কথা বলছেন কেউ কেউ। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বাজার হারানোর আশঙ্কা না করলেও ভবিষ্যতের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জনের ওপর জোর দিয়েছেন।
টিপিপি চুক্তি কার্যকর হলে ভিয়েতনামকে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাসহ ১১টি দেশে রপ্তানিতে কোনো শুল্ক দিতে হবে না। অথচ বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের ১৬ শতাংশ হারে শুল্ক দিতে হবে। এর ফলে বাংলাদেশের ৫০০ কোটি ডলারের বাজারের একটা অংশ ভিয়েতনাম কেড়ে নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন এতে ভিয়েতনামের সঙ্গে প্রতিযোগিতা কিছুটা হলেও বাড়বে। তবে, বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইন্সটিটিউটের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান সে আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন। তার মতে যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামের বাজার বাড়লে বাংলাদেশের বাজার কমবে না। সরাসরি এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে চীন, মেক্সিকো ও তুরস্কের ওপর। তবে, আপাতত খুব বেশি শংকা না থাকলেও ভবিষ্যতে বিষয়টি দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে বলে মনে করেন তারা। ভবিষ্যতের সংকট মোকাবেলায় অভ্যন্তরীণ বাধা দূর করে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন তারা। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার আওতায় বাংলাদেশের যেসব বাণিজ্য সুবিধা পাওয়ার কথা সেগুলো আদায়ে সচেষ্ট হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এই বিশেষজ্ঞরা।
এমনি এক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য একটি ভালো খবর বন্দর নগরী চট্টগ্রামে গার্মেন্টস পল্লী গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে বিজিএমইএ। প্রাথমিকভাবে নগরীর কালুরঘাটে সিটি করপোরেশনের জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সিটি করোপোরেশন পরবর্তীতে নগরীর আরও কয়েকটি জায়গায় গার্মেন্টস পল্লী গড়ে তুলবে। ১০ অক্টোবর সিটি মেয়র আজ ম নাছির উদ্দিন ও বিজিএমইএ চট্টগ্রামের নেতাদের মধ্যে বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে বন্ধ হয়ে যাওয়া বা কিছু ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা আগামী ছয়মাসের মধ্যে নতুন এ গার্মেন্টস পল্লীতে স্থানান্তর করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বিজিএমইএ'র প্রথম সহসভাপতি মঈনুদ্দিন আহমেদ মিন্টু। সিটি করপোরেশন ও বিজিএমইএ'র এ উদ্যোগে চট্টগ্রামে তথা দেশে পোশাক শিল্পের বিকাশে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশা করছে পোশাক শিল্প মালিকরা।
ঢাকা থেকে মাহমুদ হাশিম।
| ||||