২০১৫ সালে পালিত হয়েছে চীন-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৪০তম বার্ষিকী। এ উপলক্ষ্যে দু'দেশেই বেশকিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তা ছাড়া, এবছর দু'দেশের নেতৃবৃন্দের মধ্যেও একাধিক বৈঠক হয়েছে।
প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে গত ২৬ সেপ্টেম্বর চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিইউয়র্কের বৈঠকের কথা।
বৈঠকে সি চিন পিং বলেন, চীন ও বাংলাদেশ সুপ্রতিবেশী, ভালো বন্ধু, ভালো অংশীদার। দু'দেশ পরস্পরকে সম্মান করে, উপলব্ধি করে এবং সমর্থন করে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে। শিক্ষা, তথ্যমাধ্যম ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার করলে দু'দেশের জনগণই উপকৃত হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, 'এক অঞ্চল, এক পথ' কৌশল বাস্তবায়নে তার দেশ বাংলাদেশে সবসময় পাশে পাবে বলে আশা করে। তিনি জানান, তার সরকার বাংলাদেশে চীনা শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোর পুঁজি বিনিয়োগকে সমর্থন করে, উত্সাহিত করে। চীন দু'দেশের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা প্রকল্পগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য দিতে আগ্রহী বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
জবাবে হাসিনা বলেন, ৪০ বছরে দু'দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ অংশীদারিত্বের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে চীন বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজ উন্নয়নে যে সাহায্য দিয়ে আসছে, শেখ হাসিনা এ জন্য চীনকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ চীনের সাথে আর্থ-বাণিজ্যিক, অবকাঠামো নির্মাণ, মানবসম্পদ ও সংস্কৃতি বিনিময় জোরদার করতে এবং বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক কড়িডোরের কাঠামোয় সহযোগিতা করতে আগ্রহী।
২০১৫ সালের ২৪ মে চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী লিউ ইয়ান তুং বাংলাদেশ সফর করেন। এসময় বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতকালে তিনি বলেন, দু'দেশের কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৪০তম বছরে তার বাংলাদেশ সফরের উদ্দেশ্য দু'দেশের ঐতিহ্যবাহী মৈত্রী জোরদার করা, দু'দেশের নেতাদের পৌঁছানো সমঝোতা বাস্তবায়ন করা, বিভিন্ন ক্ষেত্রের পারস্পরিক কল্যাণমূলক সহযোগিতা সম্প্রসারণ করা এবং মানবসম্পদ ও সংস্কৃতি বিনিময় ত্বরান্বিত করা। চীন আর্থ-বাণিজ্যিক, কৃষি ও ইন্টারেটসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দু'দেশের সহযোগিতা সম্প্রসারণ, নিজ দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে অভিন্ন উন্নয়ন বাস্তবায়ন, দু'দেশের জনগণের জন্য কল্যাণ বয়ে আনা এবং আঞ্চলিক শান্তি ও উন্নয়ন বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী বলেও তিনি জানান। এ ছাড়া লিউ ইয়ান তুং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দু'দেশের শিক্ষা, তথ্যমাধ্যম এবং বিদ্যালয়সংশ্লিষ্ট একাধিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
এখন আমরা দেখি ২০১৫ সালে চীন-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন কোন ইতিবাচক ঘটনা ঘটেছে।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ভারত সফর করেছিলেন। আর ২০১৫ সালের ১৪ থেকে ১৬ মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীন সফর করেন। এ সফর দু'টি দু'দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে বলা যায়।
মোদির সফরকালে চীন-ভারত যৌথ বিবৃতিতে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলা হয়। এসময় চীন ও ভারতের শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ২২০০ কোটি ডলার মূল্যের ২০টিরও বেশি সহযোগিতাচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। জ্বালানি, বাণিজ্য, অর্থ ও শিল্প উদ্যানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দু'দেশ সহযোগিতা জোরদার করতে একমত হয়।
প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে সাক্ষাত্কালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং চীন ও ভারতের সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য চারটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, দু'দেশের উচিত 'এক অঞ্চল, এক পথ' কৌশল ও এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের আওতায় পারস্পরিক সহযোগিতা আরও জোরদার করা এবং যৌথভাবে উন্নয়নের পথ ধরে এগিয়ে চলা।
চলতি বছর আর্থ-বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে চীন ও ভারতের সহযোগিতায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
চীনের স্মার্ট ফোন কোম্পানী 'শিয়াও মি' ২০১৪ সালের জুলাই মাসে ভারতের বাজারে প্রবেশ করে। এর পর এ পর্যন্ত ভারতে ৩০ লাখ স্মার্ট ফোন বিক্রি করেছে কোম্পানিটি। 'শিয়াও মি' কোম্পানির চেয়ারম্যান লেই চুন বলেন, আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে ভারতে কোম্পানির সকল কর্মীই ভারতীয় হবে—এই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে তার কোম্পানি।
এ ছাড়া চীনের লেনোভো গ্রুপের উত্পাদিত লেনোভো স্মার্ট ফোন ইতোম্যধেই ভারতে চতুর্থ জনপ্রিয় স্মার্ট ফোন ব্রান্ডে পরিণত হয়েছে। ২০১৫ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে ভারতীয় বাজারের ৯.৫ শতাংশ দখল করে নেয় লেনোভো ফোনটি। আগামী বছর ভারতের বাজারের জন্য এক কোটি স্মার্ট ফোন উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে লেনোভো। এ ছাড়া, কোম্পানির লক্ষ্য ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্মার্ট ফোন কোম্পানিতে পরিণত হওয়া।
এখন আমরা চীন ও পাকিস্তানের সম্পর্কের ওপর চলতি বছরের প্রভাব খতিয়ে দেখতে চাই।
২০১৫ সালের ২০ ও ২১ এপ্রিল চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং পাকিস্তান সফর করেন। এটি ছিল ২০১৫ সালে তার প্রথম বিদেশ সফর। পাকিস্তানে ২৮ ঘন্টা অবস্থানকালে তিনি মোট ১৮টি অনুষ্ঠানে অংশ নেন। সফরকালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মামনুন হোসাইন ও প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরিফের সঙ্গে বৈঠক করেন। এসময় দু'দেশের সম্পর্ককে সার্বিক কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বের সম্পর্কে উন্নীত করার ব্যাপারে একমত হয় দু'পক্ষ।
এ ছাড়া অক্টোবর মাসের শেষ দিকে এয়ার চায়না পেইচিং –ইসলামাবাদ এবং করাচি-পেইচিং সরাসরি ফ্লাইট চালু করে। অন্যদিকে, পয়লা নভেম্বর পাকিস্তানের শাহিন এয়ার আনুষ্ঠানিকভাবে লাহোর-কুয়াংচৌ-লাহোর সরাসরি ফ্লাইট চালু করে।
২০১৫ সালে চীন ও নেপালের সম্পর্ক উন্নয়নের পথেও বেশ অগ্রগতি অর্জিত হয়।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০১৫ সাল ছিল চীন ও নেপালের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৬০তম বার্ষিকী। মার্চ মাসে নেপালের প্রেসিডেন্ট রাম বরণ ইয়াদাভ চীনে এসে বোআও এশীয় ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে অংশ নেন। এসময় তার সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বৈঠক হয়। বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদার করার বিষয় নিয়ে দু'নেতা মত বিনিময় করেন। এরপর ইয়াদাভ তিব্বত সফর করেন। নেপাল ও চীনের বিনিময়ের ক্ষেত্রে তিব্বত খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল নেপালে আঘাত হানে রিখটার স্কেলে ৮.১ মাত্রার ভূমিকম্প। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও প্রধানমন্ত্রী লি খ্য ছিয়াং ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিতে গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং চীনের আন্তর্জাতিক উদ্ধার ও ত্রাণ দল ভূমিকম্পের ২১ ঘন্টা পরই নেপালে পৌঁছে উদ্ধার ও ত্রাণকাজে অংশ নেওয়া শুরু করে। এরপর চীন সরকার ও জনগণ তিন দফায় নেপালের ভূমিকম্পদুর্গতদের জন্য ১৪ কোটি ইউয়ান জরুরি সাহায্য দেয়।
তীব্র জ্বালানি সংকট কাটিয়ে উঠতে বিগত ২৬ অক্টোবর চীন নেপালকে এক কোটি টন তেল সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দেয়। ভারত থেকে তেল আসা বন্ধ হওয়ার পর বলতে গেলে চীনের তেল দিয়েই মিটছে নেপালের চাহিদা। (ফেই/আলিম)